বেশ কয়েক বছর আগের কথা বাৎসরিক উত্তরবঙ্গ ভ্রমনের সময় মনস্থির করলাম এবার রবীন্দ্রস্মৃতিধন্য মংপু পাহাড়ে যাবো।রবীন্দ্রনাথ শুধু শান্তিনিকেতন বা জোড়াসাঁকোতেই থাকেন নি তিনি ভারত ও বিদেশের বিভিন্ন শহরে বেড়াতে গেছেন ও থেকেছেন ।তবে কবির ভ্ৰমণ তো আর আমাদের মতো ঝটিকা সফর হতে পারে না ,তিনি বেশ কিছুদিন কোনো শহরে তার আত্মীয় বন্ধুদের বাড়ি থাকতেন।তারা তাঁকে আদর যত্নে ভরিয়ে রাখতেন ।আবার বিলেতে কখনো ভাড়া বাড়ি র বাড়িওলাটি তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছেন এমন খবর ও ছিল। কবি র কাছে তো বিশ্বজোড়া ফাঁদ পেতেছো কেমনে দি ই ফাঁকি। সেই কারণেই তাঁর বিভিন্ন রচনা র নির্মাণ স্থান বিভিন্ন জায়গায়।
সেবার আমার উত্তরবঙ্গ ভ্ৰমণ শুরু হয়েছিল কালিম্পঙ শহর দিয়ে।কালিম্পঙ এর জমজমাট চক বাজার থেকে একটু দূরে বেশ নিরিবিলি একটা হোটেল এ ছিলাম।হোটেলটিকে নির্বাচন করার পিছনে সেটাই ছিল প্রধান কারণ। হোটেলে পৌঁছে আরো চমক অপেক্ষা করে ছিল জানতে পারলাম এই বাড়ি টি ছিল অবিভক্ত দিনাজপুর রাজা’র শৈলআবাস। যদিও দেখে রাজবাড়ী মনে হবে না আবার লম্বা করিডোর দেওয়া হোটেল ও নয়। হোটেলের লাইব্রেরি আর বৈঠকখানায় বেশ কিছু মেহগিনি কাঠের আসবাব বাড়ি টির ঐতিহ্য়এর পরিচয় দিচ্ছিল। পরের দিন পাহাড়ি ঠান্ডা গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়েছিলাম প্রাতঃভ্রমণে। পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে বেশ তা নামার পর ই দূরে সাদা রঙের বেশ বড় একটা বাড়ি দেখতে পেলাম, একরকম তাকে অট্টালিকাই বলা চলে। ব্যাস কৌতূহল গেলো বেড়ে ,পাহাড়ের চড়াই -উৎরাই ভেঙে আরো কিছুটা এগিয়ে তবে বাড়িটার কাছে পৌঁছাতে পারলাম। প্রকাণ্ড এক লৌহ ফটক বাড়ির সামনে তবে তা ভাঙাচোরা। ফটক থেকে বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা বেশ বড় বড় আগাছায় ঢাকা। তাই আর ভিতরে ঢোকার সাহস করলাম না। তবে মন বলছে এ বাড়ি যে সে বাড়ি হবে না। একটু চোখ চালাতেই চোখে পড়লো একটা রং উঠে যাওয়া সাইন বোর্ড, যেখানে লেখা আছে গৌরীপুর রাজবাড়ী।
একলহমায় যেন শিহরণ খেলে গেলো আমার শরীরে। এই সেই গৌরীপুর হাউস যেখানে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছুদিন ছিলেন। কবি ১৩৪৫ সালের ২৫ শে বৈশাখ নিজের জন্মদিনে তিনি “জন্মদিন” কবিতাটি আবৃত্তি করেন যা আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত হয়। এই পুণ্যভূমি তে হটাৎ করে আস্তে পেরে আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো আমার এবারে পাহাড় ভ্রমণ যেন কবি র পুজো তীর্থভ্রমণ।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি। এটি ১৯শ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজবাড়িটি ছিল গৌরীপুরের জমিদার পরিবারের বাসস্থান এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।
এই রাজবাড়ির স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় ও মোগল প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশাল প্রাসাদে ছিল বড় বড় বারান্দা, কারুকার্যময় দরজা-জানালা এবং সুসজ্জিত কক্ষ। এটি একসময় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।
বর্তমানে ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার বাড়ি টিকে মেরামত ও সংস্কার করে রবীন্দ্রনাথের ওপর সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন।
এর পরের দিন গেলাম মংপু। কালিম্পঙ থেকে মংপু যাওয়ার রাস্তা টি ও বড় মনোরম। চা বাগানে ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা।মংপু তে পৌঁছেই মন ভোরে গেলো তার শান্ত পরিবেশে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা একতালা একটি পাহাড়ি বাংলো বাড়ি। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে তিনি মোট চারবার মংপু সফর করেন।
এখানে তিনি থ তাঁর শিষ্যা ও প্রখ্যাত সাহিত্যিক মৈত্রেয়ী দেবী-র আতিথ্য গ্রহণ করে। মৈত্রেয়ীর স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীনে মংপুর সিনকোনা প্ল্যান্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট। মংপুর সৌন্দর্য, পাহাড়, মেঘ ও নির্জনতায় মুগ্ধ হয়ে কবিগুরু এখানে কবিতা, গান ও চিঠিপত্র রচনা করেন। তাঁর কিছু বিখ্যাত পত্র এবং লেখায় মংপুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে মংপুর সেই বাড়িটিকে রবীন্দ্র ভবন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেখানে কবির ব্যবহৃত আসবাবপত্র, তাঁর লেখার টেবিল, খাট, হাতের লেখা চিঠিপত্র, এবং ছবি রাখা আছে।
ভীষণ ইচ্ছে করছিলো তার টেবিল কাগজ রেখে কিছু লিখি কিন্তু তার চেয়ার টেবিল আমাদের বাঙালিদের কাছে যে দেব সিংহাসন। আমি বাগান থেকে কিছু ফুল এনে তাকে অর্ঘ্য দিলাম।বাড়ি টিতে তার রোগ শয্যা র খৎ ওষুধ খাবার পাথরের বাটি, পোশাক সব সযত্নে রাখা আছে। এমনকি বাথরুমএ বাথটাব কাঠ কয়লা দিয়ে জল গরম করে পাইপের সাহায্যে স্নানের জায়গায় সরবরাহ করার ব্যবস্থাও ছিল।ঠান্ডা ও গরম জল সরবরাহের এই ব্যবস্থার নকশা কবি নিজে করেছিলেন। বেশ কিছুক্ষন বাড়িতে ঘুরে বেড়ালাম, আমার চেতনায় উপলব্ধি করছিলাম সেই মহামানবের উপস্থিতি। সঙ্গে ছিলেন বাড়ির কেয়ার টেকার। যিনি বলছিলেন তার ঠাকুরদা রবীন্দ্রনাথের সেবা করেছেন। বাইরে এসে বাগানে বসলাম, রবীন্দ্রনাথের ই নিজের হাতে লাগানো একটি গাছে র ছায়াতে। মনে পরে গেলো তাঁর নিজের লেখা তেই পড়েছি এই বাগানেই একবার পালন করা হলো তাঁর জন্মদিন। সব আয়োজন এর সাথে স্থানীয় পাহাড়ি রাও এলো তাদের পাহাড়ি ফুল এর উপহার আর নাচ গান এর ডালি নিয়ে। কবি ভারী খুশি হয়েছিলেন এই জন্মদিন এর আয়োজন এ। আ মার মনে ভিড় করে আসছিলো মংপু তে রবীন্দ্রনাথ বইতে পড়া সব কথা। বিশ্বাস ই হচ্ছিলো না সেই বাড়িতে আমি বসে আছি। বিভোর আমি গেয়ে উঠলাম প্রতিদিন আমি, হে জীবনস্বামী, দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে করি জোড় কর ,হে ভুবনেশ্বর ,দাঁড়াবো তোমারি সম্মুখে।