ওরে পলাশ, ওরে পলাশ,
রাঙা রঙের শিখায় শিখায় দিকে দিকে আগুন জ্বলাস–
আমার মনের রাগরাগিণী রাঙা হল রঙিন তানে॥
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ছোটবেলায় স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে এই গানটা শোনার পর আমার মনের মধ্যে পলাশ ফুল এক অন্যরকম জায়গা করে নিয়েছিল। মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম, আমি পলাশ ফুলের মালা পরে পলাশফুল দিয়ে কখনো খেলবো বসন্ত উৎসব। স্বপ্ন দেখার পর অনেক বছর কেটে গেলো, বিবাহসূত্রে থাকার সুযোগ হলো কালো সোনার দেশে। পলাশ আমার সবচেয়ে প্রিয় ফুল, যদিও এই ফুলের সেরকম আকর্ষণীয় গন্ধ নেই, কিন্তু ফুলের আগুন রং আমাকে সবথেকে বেশি আকৃষ্ট করে।

‘পলাশ’-এর অনেক ভাষায় অনেক নাম রয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফুল , বাঙালির ঘরে ঘরে বসন্ত পঞ্চমীর দিন সরস্বতী পুজোতে পলাশ ফুলের চাহিদার সাথে আমরা সবাই অবগত। ভারতে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে এবং মার্চ মাসে বনে যেন আগুন রং ধরিয়ে দেয় পলাশ ফুল। এটিকে ইংরেজিতে ‘flame of the forest’ বলে, কিছু ভারতীয় ভাষায় ‘তেসু’ ‘ঢাক’ এবং ‘পরসু’ নামেও পরিচিত।

আপনি কি জানেন যে প্রতিটি ভারতীয় রাজ্যের নিজস্ব পাখি, প্রাণী, গাছ এবং ফুল রয়েছে যা সেই অঞ্চলের প্রতীক? …পলাশ ঝাড়খণ্ডের রাজ্য ফুল।

এতক্ষনে হয়তো পাঠকগণ বুঝে গেছে, আমাদের এবারের পথের পাঁচালীর গল্প পলাশের রাজ্য আগুন রঙে রাঙা ‘বড়ন্তি’। সালটা তখন ২০২২ , Pandemic এর পর Work-from-home এর কল্যানে ছুটিগুলো বেড়াতে যাওয়ার কাজেই লাগাতাম বেশি। ছোটবেলার স্বপ্নপূরণ করতে, ছেলের হাত ধরে সপরিবারে আমরা 'বড়ন্তি ’ যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।

‘বড়ন্তি’ হল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর মহকুমার সাঁতুরি (সম্প্রদায় উন্নয়ন ব্লক) এর একটি ছোট আদিবাসী গ্রাম। এটি বরন্তী হ্রদের পাশে অবস্থিত। এটি একটি শান্ত পর্যটন কেন্দ্র।

একটুকু ছোঁওয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি – তাই দিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী।
কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা, তাই দিয়ে সুরে সুরে রঙে রসে জাল বুনি॥
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ধানবাদ থেকে ‘বড়ন্তি’ এর দূরত্ব বেশি নয়। বড়ন্তি যাওয়ার পথে lake এর পাশে দেখলাম কিছু কচি কাঁচা আর বৃদ্ধারা পলাশ এর মালা গাঁথতে বসেছেন। বসন্ত ঋতুতে এখানে বেড়াতে আসা শহুরে পর্যটকদের মধ্যে এই হাতে গাঁথা পলাশ এর মালার বেশ চাহিদা। আমরাও নিলাম ১-২ মালা। মালা গুলোর থেকে ও বড় প্রাপ্তি ওদের মুখের নির্মল হাসি।

এরপর আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম ‘বড়ন্তি’ তে আমাদের রিসোর্ট এর দিকে। ‘বড়ন্তি’ হলো একটা ছোট গ্রাম যেটা ‘বড়ন্তি’ লেক কে ঘিরে গড়ে উঠেছে। এখানে পর্যটকদের মূলত আকর্ষণ হল শান্ত পরিবেশ, যেখানে নিজেকে আবার খুঁজে পাওয়া যায় , সাথে বড় প্রাপ্য হলো সূর্যাস্ত এর মনোরম দৃশ্য। সূর্য, অস্তাচলের সোনালী আভা ছড়িয়ে, বড়ন্তি lake এ ডুব দেয়।

সূর্য ডোবার পরে আমরা সবাই গুটি গুটি পায়ে আমাদের রিসোর্ট এ দিকে এগোলাম। সন্ধ্যের আড্ডা আর গান বাজনা ভালো কাটলো।

আমাদের সেইবারের ছুটির শেষে আমরা যখন বাড়ির পথে, রাস্তার ধরে দেখা পেলাম আগুন রাঙানো পলাশ বনের। বাড়ির কাছেই রাস্তার দুইধারে পলাশের বনের চোখ ঝলসানো স্মৃতি আজও আমার মনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

আজকের মতো এইটুকু। আবার আসবো আমরা অন্য কোনো পথের, অন্য কোনো পাঁচালি নিয়ে।