রবীন্দ্র-নজরুল - একসাথে গাঁথা দুটি নাম, দুই অগ্রগণ্য কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। কয়েক দশক ধরে এদের লেখা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে এসেছে। আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে প্রেম, শিখিয়েছে মানুষকে ভালোবাসতে। শিখিয়েছে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। দেশ-কালের বেড়াজাল পেরিয়ে দুজনেই আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক! কৈশোরে-যৌবন-বার্ধক্য যে কোনো সময়ের সামাজিক সম্পর্ক, প্রেম, দুঃখ ইত্যাদি মানবিক আবেগের জন্য যেমন এদের লেখা প্রাসঙ্গিক, তেমনি প্রাসঙ্গিক এদের লেখা কলমগুলি একবিংশ শতাব্দীর টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে।

“মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান”
“এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ীর টান”
– কাজী নজরুল ইসলাম

“ধর্মের বেশে মোহ
যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে
আর শুধু মরে।”
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম দুজন কবিই বড়োই প্রিয়। বাঙালির ভালোবাসা সাহিত্যের প্রতি, এদের ধার্মিক বিশ্বাসের প্রতি নয়। আজ যখন ধর্মের সাথে রাজনীতি মিশে একাকার, তখন আরো বেশি প্রয়োজন এই দুজন কবিকে স্মরণ করা, স্মরণ করা এদের লেখা এবং লেখার মাধ্যমে এঁরা সমগ্র বাঙালির কাছে যে বার্তা পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তা মনে রাখা। তাদের লেখায় বারে বারে ফুঁটে উঠেছে সাহিত্যের মাধ্যমে মনুষ্যত্ব সৃজনের প্রচেষ্টা।

রবীন্দ্রনাথের কথায় - “প্রত্যেক মানুষের পক্ষে মানুষ হওয়া প্রথম দরকার। অর্থাৎ, মানুষের সঙ্গে মানুষের যে লক্ষ লক্ষ সম্পর্ক সূত্র আছে, যার দ্বারা প্রতিনিয়ত আমরা শিকড়ের মতো বিচিত্র রস আকর্ষণ করছি, সেগুলোর জীবনশক্তি বাড়িয়ে তোলা, নতুন নতুন ক্ষমতা আবিষ্কার করা, চিরস্থায়ী মনুষত্বের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ট যোগসাধন করে ক্ষুদ্র মানুষকে বৃহৎ করে তোলা - সাহিত্য এমনি করে আমাদের মানুষ করেছে।”

ফিনল্যাণ্ড সহ সমগ্র ইউরোপে আজ ডানপন্থী শক্তি দেশে দেশে আবার মাথা চারা দিয়ে উঠেছে শরণার্থীদের ও তাদের ধর্মের বিরুদ্ধে, উদ্গার করছে তীব্র ঘৃণা। এর রেশ একদিন ইউরোপের প্রত্যেক অভিবাসীদের ওপর এসে পড়বে। যারা ভাবেন যে তারা এসবের উর্ধে, ধরাছোঁয়ার বাইরে, তাদের হয়তো এক ঝলক ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখার প্রয়োজন আছে। ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে যে মার্টিন নেইমলার শুরুতে জাতীয়তাবাদী ছিলেন ও হিটলারের সমর্থক ছিলেন, তিনি পরবর্তীকালে জেলে যাওয়ার পর প্রবল অনুশোচনা করেন সময়কালে ইহুদিদের সাহায্য না করার জন্য, ও এই পংক্তিগুলো লেখেন -

প্রথমে ওরা সোশালিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি সোসালিষ্ট নই।
তারপর ওরা ট্রেড উনিয়নিস্টদের জন্য এসেছিলো, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি ট্রেডইউনিয়নিস্ট নই।
তারপর ওরা ইহুদিদের জন্য এসেছিলো,আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
তারপর ওরা এসেছিলো আমাকে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কথা বলার মত তখন আর কেউ ছিল না।

সারা বিশ্বে যখন জাত-ধর্মের ঘৃণার মেঘ আকাশকে কালো করে রেখেছে, তখন প্রয়োজন নিজেদের প্রশ্ন করা - মানুষত্ব মানে কি ঘৃণা না প্রেম?

প্রয়োজন মনে রাখা স্বামী বিবেকানন্দের লেখা - “জীবে প্রেম করিছে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর।”

প্রয়োজন, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল এর কবিতা ও লেখা অনুভব করা ও আমাদের আগামী প্রজন্মকে সঠিক পথ দেখানো। আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা দায়বদ্ধ - কলা ও সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে মানুষত্ব সৃজন করার।সৃজন-এর এই বিশেষ সংখ্যা সেই উদ্দেশ্যের প্রতি অর্পিত!