সারাংশ
রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর এ স্মরণীয় মুহূর্তে তাঁদের কাব্যিক ও সাহিত্যিক সৃষ্টির মধ্যে নিহিত দর্শনের প্রভাব নিয়ে পৰ্য্যালোচনা করার প্রয়াস হিসেবেই এ লেখাটা উপস্থাপিত হয়েছে। অনস্বীকার্যভাবে গত প্রায় ১৪০ বছরের বাঙালি মানসকে এ দুই মনীষী তাঁদের সাহিত্যিক দর্শনের মাধ্যমে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছেন। এটা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে বাঙ্গালীর সংস্কৃতি মননে, আধ্যাত্বিক ভাবনা-চিন্তায়, পারস্পরিক সৌজন্য বিনিময়ে, মানসিক দৈন্য নিরসনে, দেশপ্রেমের গভীরতার উপলব্ধিতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সাহসিকতায়, সর্বোপরি একটা আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে নিজেদেরকে প্রস্তুত করার প্রচেষ্টায়। রবীন্দ্র-নজরুল দর্শনের অশেষ প্রভাবের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ।
এ নিবন্ধে তাঁদের দর্শনের গুটিকয়েক দিককে ( কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে: বিবর্তনবাদ ও বিশ্ব মানবতাবাদ, শিক্ষা দর্শন,ভাববাদ ও ধর্মদর্শন; বিদ্রোহী কবি নজরুলের ক্ষেত্রে: বিদ্রোহী দর্শন, ধৰ্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষতার দর্শন ইত্যাদি) উল্লেখ করে পাঠককে এ ব্যাপারে তথ্যসূত্রের উল্লেখ করে গবেষণামূলক অধ্যয়ন এবং বিশ্লেষণ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি তাঁদের দার্শনিক মানসিকতার উপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়াস হিসেবেই বিষয়টি নিয়ে লেখা এ ছোট্ট নিবন্ধে।
রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীর এ স্মরণীয় মুহূর্তে তাঁদের কাব্যিক ও সাহিত্যিক সৃষ্টির মধ্যে নিহিত দর্শনের প্রভাব নিয়ে পৰ্য্যালোচনা করার প্রয়াস হিসেবেই এ লেখাটা উপস্থাপিত হয়েছে। এ কথাটা তো সত্য যে গত প্রায় ১৪০ বছরের বাঙালি মানসে এ দুই মনীষী বিভিন্ন সাহিত্যিক সৃষ্টির মাধ্যমে বহুবিধ ইতিবাচক অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন। এ সবকিছুই মধ্যবিত্ত বাঙালির চরিত্রের উপর একটা বিশেষ ভূমিকা নিয়ে প্রতিভাত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলের বয়সের তফাৎ প্রায় ৩১ বছর, এক প্রজন্মেরও বেশী। তাই তাদের দার্শনিক বৈশিষ্ট্যগুলোও যুগোপযোগী ধারার সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্নভাবে বাঙালি ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। তাই একসাথে গুলিয়ে না ফেলে আলাদাভাবে আলোচনা করে বাঙ্গালী জীবনে এই দুজন ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্বের বহুবিধ প্রভাবের অংশবিশেষের উপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করবো।
রবীন্দ্র দর্শনের পরিসরে মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রই গভীরতম স্তরে বিশ্লেষিত হয়েছে। বিশ্বকবির লেখনীর শ্রেষ্ঠত্বের গুণে তাঁর দর্শনের ভাবধারার প্রতিফলন মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছে অত্যন্ত সহজভাবে। দার্শনিকের চিন্তাধারা যদি স্বয়ং সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর নিজেরই লেখায় প্রতিভাত হয়, তবেই তা অপামর জনসাধারণের পক্ষে অনুধাবন করা সহজ হয়। কবিগুরু তা করেছিলেন অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রতিটা মানুষের ক্রিয়া-কলাপ , ব্যবহার ও ভাবনার গভীরতম বিশ্লেষণের মাধ্যমে। মানব জীবনের প্রতিটা অনুভূতির সম্যক রূপ তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর সৃষ্টিতে। জীবনের সমস্ত দিকগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ ও চর্চার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়েছে হয়েছে রবীন্দ্র দর্শন। এ দর্শনের শুধু কয়েকটা বিশেষ দিক অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে আলোচিত হবে এ নিবন্ধটিতে। রবীন্দ্র দর্শনের উপর বিস্তারিত আলোচনা এ নিবন্ধের স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। এখানে শুধু রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান দিকগুলোর উল্লেখ করে এ ব্যাপারে যে অসংখ্য লেখা রয়েছে,সে সূত্রগুলোর একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা দেয়া হল। যে কেউ ইচ্ছে করলে সেগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। উইকিপেডিয়াতেও রবীন্দ্র দর্শনের উপর বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
রবীন্দ্র দর্শনের বিভিন্ন দিক
বিবর্তনবাদ ও বিশ্ব মানবতাবাদ
কবিগুরু ১৯৩০ সালের মে মাসে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাঞ্চেস্টার কলেজে ‘মানুষের ধৰ্ম’ শীর্ষক এক বক্তৃতায় বিশ্ব মানবতা নিয়ে তাঁর চিন্তাধারাকে তুলে ধরেছিলেন। চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার সাথে তিনি আদি মানবের ব্যক্তি মানবতার বিবর্তনের উপরও জোর দিয়েছিলেন। আমাদের পূর্বসূরিদের দৈহিক পরিবর্তনের সাথে সাথে যে তাদের মানসিকতার বিবর্তন ঘটেছিল এবং তার ফলে আমাদের আজকের পৃথিবীর মানবিকতার যে স্তরে মানব সমাজ উন্নীত হয়েছে, তা তিনি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেন। তবে মানুষ বিবর্তনের সর্বোচ্চ পর্য্যায়ে উন্নীত হয় তখনি যখন ব্যক্তি মানবতার অনুশীলন ধীরে ধীরে তাকে বিশ্ব মানবতার স্তরে পৌঁছে দেয়।
শিক্ষা দর্শন
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন এমন কতগুলো বিষয়ের উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট, যা বাস্তবে রূপায়িত করতে তিনি শান্তিনিকেতনে গড়ে তুলেছিলেন বিদ্যা নিকেতন, যা পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নামে আমরা জানি। প্রকৃতির প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে সমসাময়িক পৃথিবীতে সাধ্যানুযায়ী অবদান রেখে যাওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার ব্রত নিয়েই শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণ শুরু হয় এখানে। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষণ পদ্ধতি তিনটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত— ১) স্বাধীনতা ২) সৃজনশীলতার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ৩) প্রকৃতির সঙ্গে সক্রিয় সংযোগ (৪)
তথ্যসূত্রে (৪) কবিগুরুর শিক্ষানীতি ও দর্শনের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই এখানে তার পুনরুক্তি অপ্রয়োজনীয়।
ভাববাদ ও ধর্মদর্শন
ধর্মতত্ত্ব ও ভাববাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দর্শনের উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তথ্যসূত্র (৫) - এ। তা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রবাদীতা নিয়েও আলোচনা হয়েছে বিভিন্ন লেখায়। সেগুলো গুগল সার্চ করলেই সহজেই পাওয়া যাবে।
সর্বশেষে এটা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে। প্রতিটি কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে, তথা বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর দর্শন অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দৃষ্ট। তাঁর আরো একটা কথা না বললেই নয় যে আধুনিক বাংলা ভাষার (যাকে কখনো কখনো বলে হয়ে থাকে চলিত ভাষা) সাহিত্যক্ষেত্রে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্য লিখিত হতো সাধু ভাষায়।
নজরুল দর্শন
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অবদান বাংলা সাহিত্যে অনস্বীকার্য। তিনি উল্কার মতো বাংলার সাহিত্য গগন আলোকিত করে মাত্র আড়াই দশকের কম সময়ের মধ্যেই বিদায় নিলেন। বাঙ্গালী জাতির দুর্ভাগ্য যে বাংলা সাহিত্য তাঁর অমূল্য দীর্ঘকালীন অবদান থেকে বঞ্চিত রইলো। তবুও তাঁর জীবনের স্বল্প সময়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করে গিয়েছেন অসংখ্য গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক দ্বারা।
নজরুলের দর্শনের প্রধান দুটি দিক হলো:
বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রতিফলন
অসংখ্য কবিতা, গান ও লেখায় তাঁর বিদ্রোহী সত্ত্বার প্রকাশ ছিল অতীব তীব্র। রাজনীতিগতভাবে তিনি জনগণকে অন্যায় ও বিদেশী শাসনকে দূরীভূত করতে কঠিন সময়ের মোকাবেলা করে দেশাত্ববোধক অনুভূতির থেকে শক্তি ও সাহস আহরণের জন্য আহবান জানান।
ধৰ্ম ও সম্প্রদায় নিরপেক্ষতা
বিভিন্ন জাতি-ধৰ্ম-বর্ণে বহুবিভক্ত ভারতীয় সমাজকে কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিধিনিষেধের পরিধি থেকে বেরিয়ে এসে একতাবদ্ধ হয়ে স্বাধীন সত্ত্বাকে প্রতিষ্ঠিত করতে জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানান।
তথ্যসূত্রে (৬) নজরুলের চিন্তা ও দর্শন সম্বন্ধে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।