রবীন্দ্র সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে কাদম্বরী দেবীর প্রসঙ্গ না আনলে অনেক কথাই না বলা থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার ব্যাপারে কাদম্বরী দেবীর অনুপ্রেরণা অনস্বীকার্য। জ্যোতিদাদার স্ত্রী কাদম্বরী দেবী রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান। এই নতুন বৌঠান ঠাকুর বাড়িতে যখন বৌ হয়ে আসেন তখন তাঁর বয়েস ৯ এবং রবীন্দ্রনাথের ৭। বয়েসের এই সামান্য ব্যবধান তাঁদের সম্পর্ক আরো বন্ধুত্বপূর্ণ ও নিবিড় করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ কৈশোরে মাতৃহারা। এই মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেটিকে স্নেহের বন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন নতুন বৌঠান।
ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথ স্কুল থেকে ফেরার পর নতুন বৌঠানের হাতে মাখা লংকার আভাস দিয়ে পান্তাভাতের সঙ্গে একটু চিংড়ির চচ্চড়ি যদি পেতেন , তাহলে সেদিন আহ্লাদে আটখানা , আর যেদিন স্কুল থেকে ফিরে নতুন বৌঠানকে দেখতে পেতেন না , সেদিন সারাক্ষণ মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকতো। পৈতের সময়ে কাদম্বরী হাবিষ্যান্ন রেঁধে দিয়েছিলেন দুই ভাই কে। রবীন্দ্রনাথ সেই ৩ দিনের খাবার স্বাদ জীবনে ভুলতে পারেননি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই সময় জমিদারী দেখার দায়িত্ব পান। দুপুরে যেতেন কাছারিতে। সেখানে তাঁর জন্য রুপোর রেকাবিতে ফল মিষ্টি পাঠানো হতো। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন "বৌঠাকুরণ ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন। নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকতো তার সঙ্গে , আর তার উপর ছাড়ানো থাকত গোলাপের পাপড়ি। গেলাসে থাকতো ডাবের জল কিম্বা ফলের রস , কিম্বা কচি তালশাঁস বরফে ঠান্ডা করা। "এমন নিখুঁত যত্ন বৌঠানের হাতথেকে রবীন্দ্রনাথের পেতে ইচ্ছে করতো।
কাদম্বরী দেবী সাহিত্যের বড়ো সমঝদার ছিলেন। তাঁদের সাহিত্যের আসরে আসতেন জ্যোতিরীন্দ্রনাথের সহপাঠী অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী, প্রবীণ কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী, রবীন্দ্যনাথ তো ছিলেনই , আসতেন স্বর্ণকুমারী দেবী এবং জ্যোতিরীন্দ্রনাথ। এই আসরেই ঠিক হয় জ্যোতিরীন্দ্রনাথ একটা পত্রিকা প্রকাশ করবেন। দ্বিজেন্দ্রনাথ এই পত্রিকার নাম দিলেন “ভারতী” ,এই ভারতী পত্রিকার প্রাণ ছিলেন কাদম্বরী দেবী। ইনি বিহারীলাল চক্রবর্তীর রচনার বিশেষ অনুরাগিণী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের রচনা কবির সমতুল্য না হওয়ার জন্য কাদম্বরী দেবী তাঁকে খোঁটা দিতেন। অবশ্য এই খোঁটা রবীন্দ্রনাথের জীবনে সাপে বর হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনা পরিশীলিত, পরিমার্জিত করে বিশ্ব কবির আসনে বসার অধিকার অর্জন করেছিলেন। পরক্ষ ভাবে কাদম্বরী দেবীর খোঁটাই হোক বা আন্তরিক তাগাদাই হোক , যা রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি করে তুলেছিল।
নতুন বৌঠান ভারি শৌখিন ছিলেন। তেতলার ছাদের একঅংশে তাদের থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল, অন্যঅংশ ছিল ফাঁকা। এই অংশে তিনি বেল ,চামেলী , রজনীগন্ধা , জুঁই , দোলনচাঁপা প্রভৃতি গাছ নিজের হাতে লাগলেন। নাম দিলেন “নন্দনকানন।” সংগীতের প্রতি কাদম্বরী দেবীর বিশেষ আগ্রহ ছিল। এই বাগানে বসত গানের আসর। কাদম্বরী দেবী গা ধুয়ে , চুল বেঁধে বসতেন সেখানে।জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বাজাতেন বেহালা আর রবীন্দ্রনাথ চড়া সুরে গান ধরতেন , সে সুরের রেশ ছড়িয়ে পড়তো চাঁদের পরে অন্য কোথাও। কাদম্বরী দেবীর আর একটি বিশেষ পরিচয় ছিল, তিনি অসাধারণ সাহিত্য প্রেমী ছিলেন। পড়তেন দ্বিজেন্দ্রনাথের "স্বপ্ন প্রয়াণ ", বঙ্কিমচন্দ্রের “বিষবৃক্ষ।” দুপুর বেলায় রবীন্দ্রনাথ ও পড়ে শোনাতেন তাঁকে।
কাদম্বরী দেবী নিঃসন্তান ছিলেন। কিন্তু তাঁর অন্তরে মাতৃত্বের ফল্গুধারা বয়ে চলতো অবিরত। স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোট মেয়ে ঊর্মিলাকে তিনি নিজের সন্তানের মতো পালন করতেন।দুর্ঘটনা বসত ঊর্মিলার মৃত্যু হয়। এই মৃত্যুশোক কাদম্বরী দেবীর অন্তরে গভীর আঘাত এনেছিল। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন বলে এই মেয়েটিকে নিজের মনে করে আঁকড়ে ধরেছিলেন।কিন্তু ঊর্মিলার অকস্মাৎ মৃত্যু তাঁকে শোক করে তোলে। নতুন বৌঠান কোনোদিন মা হতে পারেননি বলেই ঠাকুর পরিবার থেকে অনেক গঞ্জনা শুনতে হয়েছে। এমনকি তাঁর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তার এই শূন্যতাকে মেনে নিতে পারেননি। স্বামীর এই অমানবিকতা কাদম্বরী দেবী কে গভীর দুঃখ দিতো।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরী দেবীর যে নিবিড় সখ্যতা ছিল তার কারণ এঁদের বয়েসের দূরত্ব নিতান্ত কম ছিল, আর ছিল নতুন বৌঠানের সাহিত্য প্রীতি শৌখিনতা এবং আধুনিক মনস্কতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক ও গভীর আগ্রহ। সাংসারিক অবহেলা এবং জ্যোতিদাদার নটি বিনোদিনীর প্রতি তীব্র আকর্ষণ কাদম্বরী দেবীর মনকে ক্ষত বিক্ষত করত। এই দুঃসহ মানসিক অবস্থার সময় রবীন্দ্রনাথের সহৃদয় সাহচর্য অনুক্ষণ অনুভব করেছেন কাদম্বরী দেবী।
যেবার বর্ষায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী হাওয়া বদলাতে গেলেন শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধরে বাগানবাড়ীতে , সে সময়ে সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বর্ষার নবধারা জলে প্রকৃতির উদ্দাম বুকে নতুন বৌঠানের সাথে নৌকা বিহার করতে করতে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন তাঁর শৈশব সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ তাঁর "ভগ্নহৃদয় "কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেন তাঁর নতুন বৌঠানকে। এদিকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করলেন জাহাজের ব্যবসা শুরু করবেন। পুরোনো জাহাজের খোল কিনে তাতে নতুন ইঞ্জিন লাগিয়ে নতুন চোখ জুড়ানো কামরা তৈরী করে জাহাজ চালালে মন্দ হয় না, তাতে খরচ ও কম হবে আবার পয়সার আমদানি ও ভালোই হবে। পরিকল্পনা মতো কাজ শুরু হলো। জাহাজের নাম রাখা হলো "সরোজিনী ", ১৮৮৪ সালের ১৯শে এপ্রিল জাহাজকে জলে ভাসানো হলো। এর সাথে জ্যোতি ঠাকুর ও গভীর অন্ধকারে বিসর্জিত হলেন, তা তিনি জানতে পারলেন না। এই উদ্বোধনের দিনে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী , তাঁর ছেলেমেয়েরা, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ , রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ সবাই উপস্থিত ছিলেন।এই সঙ্গে বহু বিষেন গন্যমান্য ব্যাক্তিরাও নিমন্ত্রিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন না শুধু কাদম্বরী দেবী। কথা ছিল সুবিধা মতো তাঁকে ঠাকুরবাড়ী থেকে নিয়ে আশা হবে। কিন্তু এমনি নিষ্ঠূর নিয়তি নতুন জাহাজ চলতে গিয়ে বালির ছড়ায় আটকে গেলো। তাতে এক বিপত্তি বাঁধলো। জাহাজ আর চলে না , সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, কাদম্বরী দেবীকে কেউ আর সময় মতো আন্তে যেতে পারলো না। কাদম্বরী দেবী চির অভিমানিনী অপেক্ষ করতে করতে ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো , স্থির করলেন জীবন আর রাখবেন না। নিজের কাছেই আফিন মজুত ছিল। তারই খানিকটা খেয়ে নিলেন , এরপর যা হবার তাই হলো। তাড়িতাহত ভুজঙ্গালাতার মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। সংসারে উপেক্ষিতা , স্বামীর কাছে অনাদৃতা , শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের মানস প্রতিমা এই ভাবে অকালে চলে গেলেন।
২১শে এপ্রিল ওনার মৃত্যু ঘোষণা করা হয়। মৃত্যুর পর যা কিছু করনিয় ছিল তা দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে ঠাকুরবাড়িতেই সম্পন্ন হলো। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ বড় মর্মাহত হলেন। আমৃত্যু তিনি তাঁর নতুন বৌঠানকে ভুলতে পারেননি।