বিশ্বাস করুন, বাই একেবারেই ওঠেনি। এবারে ঠিক করেই রেখেছিলাম যে জুলাই মাসটা আমরা ফিনল্যান্ডেই কাটাবো, কিন্তু ওই আর কি, ছেলের মুখ চেয়ে সেটি আর হয়ে উঠলো না। টানা ১ মাস স্কুলের ছুটি কাটিয়ে অবশেষে একেবারে অতিষ্ট হয়ে, সে বলেই বসলো যে – ’বাবা, এবারে কি আমাদের আর কোথাও ঘুরতে যাওয়া হবে না?’ আর আমিও তৎক্ষণাৎ উত্তরে বললাম যে – ’না বাবা, এবারে Summer টা আমরা এখানেই কাটাবো।’ চোখ-মুখের ভাব ভঙ্গিমায় সে স্পষ্ট করে দিলো যে এই প্রস্তাবটি তার একেবারেই পছন্দ হয় নি, তবে বড় হচ্ছে তো তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে অগত্যা ’ওকে’ বলেই ছেলে আমার কথোপকথনে ইতি ঘটালো। একটু পরে অবশ্য এটাও বললো ’যে আসলে আমরা তো প্রত্যেক বছর ই কোনো না কোনো নতুন দেশে গিয়ে থাকি, তাই ভাবছিলাম যে যদি এবারেও কোথাও যাওয়া যায় কি না। But no pressure.’
এবার কিন্তু আমারও মনে হলো – সত্যিই তো, গরমকালে নতুন কোথাও না গেলে ছুটিটা কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে আমরা শেষমেশ ঠিক করলাম যে নিজেদের গাড়ি নিয়েই যাবো নরওয়ের ট্রোম্সোতে। এমনিতেই ছোটবেলায় পড়েছি যে নরওয়ে হল নিশীথ সূর্যের দেশ। এবার সেইটিকে চাক্ষুস অনুভব করার লোভটা ঠিক সামলাতে পারলাম না। মনে যদিও বা একটু ভয় ছিল যে এতটা ড্রাইভ করতে হবে, তাও আবার একা। তার কারণ হল যে আমরা থাকি এস্পোতে যেটি ফিনল্যান্ডের দক্ষিণে অবস্থিত আর ট্রোমসো হল সুদূর উত্তরে, ধরুন ১৩০০ কিঃমিঃ এরও বেশি পথ। তার উপর আবার পুরো ট্রিপটাকে প্রপার প্ল্যানিংও করতে হবে। সুতরাং শুরুতে বাই না থাকা সত্তেও, এবারে কিন্তু হটাৎই যাকে বলে আদাজল খেয়ে লেগে পরলাম ট্রিপ প্ল্যান করতে।
প্রথম দিন আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়লাম এস্পো থেকে। সড়কপথের যাত্রা যেহেতু বেশ লম্বা, তাই ফিনল্যান্ডের উত্তরে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তায় বেরোনোর পরেই চারপাশের অপরূপ সবুজ, বনভূমি আর হ্রদ যেন চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছিল। গাড়ির জানালার বাইরে ফিনল্যান্ডের গ্রীষ্মের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে গোটা দিনটাই কেটে গেল। রাতে এক ছোট্ট শহর, Ylitornio তে হোটেলে থামলাম – ছেলেও খুশি হলো, কারণ দীর্ঘ ড্রাইভের পর একটু হাঁটাহাঁটি, রাতের খাবার আর বিশ্রাম বেশ আনন্দের লাগলো। জায়গাটি Torne নদীর তীরে, এপারে ফিনল্যাণ্ড আর ওপারে সুইডেন। অপরূপ সুন্দর এই স্থানটা কিন্তু মশার উপদ্রব ও সাংঘাতিক। মানে দেশে থাকাকালীনও এত মশা আমরা কোনোদিনও পাই নি।
দ্বিতীয় দিন সকালে আবার রওনা হলাম, এবার গন্তব্য ট্রোম্সো। প্রথম দিনে প্রচুর ঊৎসাহ নিয়ে যেহেতু আমরা অনেকটা পথ অতিগ্রমন করে নিয়েছিলাম, তাই পরের দিনের যাত্রাটা ততটা ক্লান্তিদায়ক মনে হচ্ছিল না। এই রাস্তায়, কখনও পাহাড়ি টান, কখনও লেকের ধার দিয়ে যাওয়া – এ যেন সত্যিই সিনেমার মতো এক ভ্রমণ। দুপুরের দিকে নরওয়ের সীমানা পার হতেই প্রকৃতির রূপ যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠলো। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা নদী, দূরে তুষার ঢাকা শৃঙ্গ – সবকিছুই এক অন্যরকম অনুভূতি জাগাচ্ছিল। সন্ধ্যার দিকে পৌঁছে গেলাম ট্রোম্সো শহরে।
টানা তিনদিন ট্রোম্সোতে থাকব। শহরটা কেমন যেন ছোট অথচ প্রাণবন্ত। ঢুকে না ঢুকেই গেলাম আর্কটিক ক্যাথেড্রালে – আধুনিক নকশার গির্জা, ভেতরের শান্ত পরিবেশ যেন মুগ্ধ করে দিলো। চারপাশে ফিয়র্ড, সমুদ্র আর পাহাড় মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য। ছেলে আর বৌ মুগ্ধ হয়ে ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিল। আমার আবার এইসবে বেশি মন নেই, আমি চোখের ক্যামেরাতেই ট্রোমসোকে বন্দি করে রাখলাম আজীবনের জন্য। তারপরে ট্রোমসো শহরটাকে একটু হেটে ঘুরলাম আর যা হয় আরকি, কেনাকাটা তো করতেই হবে, স্পেশালি সুভেনিয়ের। রাতে ডিনার শেষ করে, ঘরের মনোরম পরিবেশেই ’মিডনাইট সান’ দেখলাম – রাত বারোটায়ও সূর্য ডুবে না, আকাশে এক অদ্ভুত সোনালি আভা। যদিও বা ফিনল্যান্ডেও এরকম আভা আগেও দেখেছি কিন্তু ’মিডনাইট সান’ এই প্রথমবার। আমরা তিনজনই এই অভিজ্ঞতায় অবাক হয়ে গেলাম, মনে হচ্ছিল সময় যেন থমকে গেছে।
তৃতীয় দিনে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ফিয়র্ড এক্সপ্লোর করতে। সাগরের ঢেউ, চারপাশে পাহাড় আর আকাশের খোলা রঙ – এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। পথে সি-বার্ডসও দেখলাম। ছেলে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলো। দুপুরের পর আমরা রওনা দিলাম ট্রোম্সো থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে থাকা ছোট্ট দ্বীপ Sommarøy-এর পথে। পথটা এত সুন্দর যে গাড়ি থামিয়ে বারবার ছবি তুলতে ইচ্ছে করছিল, আমার না, আমার স্ত্রী আর পুত্রের। পৌঁছে দেখি সমুদ্রের ধারে সাদা বালির সৈকত, টারকোয়েজ রঙের জল – যেন উত্তর নরওয়ের এক লুকানো রত্ন। গ্রীষ্মকাল বলে সূর্যের আলো চারপাশে ঝলমল করছিল, অথচ বাতাসে শীতলতার ছোঁয়া। আমরা সৈকতে একটু হাঁটাহাঁটি করলাম, ছেলে সমুদ্রের ধারে দৌড়ে খেললো আর আমি আর আমার স্ত্রী নিরিবিলি প্রকৃতিকে উপভোগ করলাম।
চতুর্থ দিনের সকালে রওনা দিলাম Skibotn-এর দিকে। ছোট্ট শহরটা পাহাড় আর সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, যেন ছবির মতো। এখান থেকে আমরা গাড়িসহ একটি বড় নৌকায় উঠলাম। নৌকার ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা—এ এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। গাড়ি আমাদের সঙ্গে থাকায় মনে হচ্ছিল যেন আমরা সমুদ্র পেরিয়ে যাচ্ছি পুরো পরিবার নিয়ে, একেবারে নিজের ভ্রমণঘরকে সঙ্গে নিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছালাম আরেকটি ছোট দ্বীপে। তারপর সেখান থেকে আরো ছোট ছোট দ্বীপ আর ফিয়র্ড ঘুরে অবশেষে বিকেলে আমরা ট্রোমসোতে ফিরে এলাম।
পঞ্চম দিনে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম। এবার সুইডেন হয়ে ফিরতে চাইলাম, তাই সেদিকে গাড়ি চালালাম। পথে এক সুইডিশ শহরে রাত কাটালাম। ক্লান্ত হলেও মনে হচ্ছিল এই ভ্রমণ আমাদের সবার জন্যই সত্যিই বিশেষ কিছু হয়ে রইলো।
শেষ দিনের যাত্রা ছিল দীর্ঘ, তবে মনের ভেতর আনন্দ ভরা। একের পর এক দেশ পেরিয়ে, সুন্দর সব দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে অবশেষে আমরা ফিরে এলাম আমাদের প্রিয় এস্পোতে। এই ৬ দিনে আমরা প্রায় ৩৫০০ কিঃমিঃ অতিবাহিত করলাম। ছেলে গাড়ি থেকে নামতেই বললো – ’বাবা, এবারের ট্রিপটা সত্যিই দারুণ হলো।’ আমি আর আমার স্ত্রী একে অপরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। হ্যাঁ, সত্যিই—এবারের যাত্রা হয়ে রইলো স্মরণীয়, যেখানে পরিবার, প্রকৃতি আর অভিযানের মিশেলে তৈরি হলো গ্রীষ্মের এক অমূল্য স্মৃতি।