পুজো মানে ঢাকের তাল, পুজো মানে শিউলি ফুল, পুজো মানে দূর থেকে আসা হালকা মাইক এর গান, পুজো মানে নতুন জামা, আর পুজো মানে ঠাকুর দেখা। ফেলে আসা এই দিন গুলোকে হয়তো আমরা আর ফিরে পাবো না, কিন্তু খানিকটা তো ধরে রাখা যায়। এই সুদূর দেশে, আমরা বাঙালিরা কি এই উপহারটি আমাদের ছোটদের দিতে পারিনা? এটাই আমাদের এই বছরের প্রচেষ্টা। গান, নাচ, আবৃতি, নাটক ও সাজশয্যার মাধ্যমে আমাদের প্রচেষ্টা, যেন এই অমূল্য স্মৃতি গুলোকে পরবর্তী প্রজন্ম অনুভব করতে পারে।
মনে পড়ে কি, সেই সাদা কালো টিভির পর্দা? করুন সুরে এক গোলাকার অ্যানিমেশন, দূরদর্শনের পর্দায় ফুটে উঠতো, আর দুটি চোখ, পলক না ফেলে অধীর প্রত্যাশায় অপেক্ষা করতো তার প্রিয় অনুষ্ঠানের। চিত্রহার, সুরভী, রামায়ণ, ছুটি ছুটি ইত্যাদি। এক সপ্তাহের অপেক্ষা সেই প্রিয় অনুষ্ঠান দেখার, মুহূর্ত মিস হয়ে যাওয়ার দুঃখ, মহাভারতের সময় নিরিবিলি রাস্তা - আজকের এই নেটফ্লিক্স এর দুনিয়ায় সেই অপেক্ষার আনন্দ কিন্তু নেই।
চলুন নিয়ে যাই অন্য আর এক স্মৃতিতে। যেখানে ইন্টারনেটের আবির্ভাব হয়নি। সেই সময় ছুটি মানে মামা মাসির বাড়ি কিংবা বাবার LTA ভাঙিয়ে দীপুদা ভ্রমণ। কি বুঝলেন না, দীঘা, পুরি, দার্জিলিং। সন্ধে বেলায় পাড়ার রকে আড্ডা মারা আর লোডশেডিং এর গরমে, হাত পাখার হালকা হাওয়া। কোনো আত্মীয়র অনুষ্ঠান বাড়িতে, ঢালাও বিছানায় কুচো কাচাদের হাঁসির ফোয়ারা আর বাড়ির বড়োদের পাশে বসে তাদের তাসের আসরে সঙ্গ দেওয়া। স্কুলের বাইরে আচারওয়ালার কথা মনে আছে? টক ঝাল মিষ্টি সেই স্বাদ এখনো জিভের ডগায় সুড়সুড়ি দেয়। অজানা ব্র্যান্ডের আইসক্রিম খেয়ে, কমলা জিভ বন্ধুদের দেখানোর মজাই আলাদা ছিল। ভারত বন্ধের দিনগুলো মনে আছে? সুনসান রাস্তায় সবাই মিলে ক্রিকেট খেলা। পাশ থেকে জীর্ণ ফেরিওয়ালার সস্তা “পেপসি” চুষে চুষে খাওয়া। নোংরা ড্রেন এর ভেতর থেকে হাত ঢুকিয়ে বল বের করে সেই হাথেই টিউবওয়েল চেপে মুখ লাগিয়ে জল খাওয়া। আমাদের কিন্তু শরীর খারাপ হতো না। রোদ, জল, বৃষ্টিতে ঘন্টার পর ঘন্টার কাটানোর পরে জীবন উর্জা আরো যেন বেড়ে যেত।
মা আসছেন! এই অনুভুতি কিন্তু শুরু হতো ভোকাট্টার আওয়াজ দিয়ে। বিশ্বকর্মা পুজোর সকালে ছাদে ছুটে যাওয়া, নতুন মাঞ্জায় হাতের কড়ি কেটে, তাতে ব্যান্ডইড লাগিয়ে, রোদ উপেক্ষা করে, কখনো টেনে আর কখনো লেটে চলত ঘুড়ির লড়াই। কিছুদিন পরেই তো মহালয়া। মা এর হুকুম, “ওঠ রেডিও চালাচ্ছি” - আধখোলা চোখে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বাবুর গলায় মহিষাসুরমর্দ্দিনী শোনা। তখন কিন্তু আবহাওয়া হালকা ঠান্ডা হয়ে উঠেছে। হালকা একটি চাদর গায়ে লাগতো। মহালয়া মানেই পুজো প্রায় চলে এসেছে। বাবা কি পুজোর বোনাস টা পেলো? নতুন জামা কিনতে নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে এ মেলা ভিড়। তারপর আমিনিয়া বা নিজাম এ বিরিয়ানী খেতে হবে তো? এর পর নতুন জামা পড়ে পুজোর পাঁচটি দিন, ম্যাডক্স স্কোয়ারে বা কলেজ স্কয়ারে আড্ডা আর রাস্তার সস্তা রোল চাউমিন খাওয়া।
অতীতকে আঁকড়ে ধরে ভবিষ্যৎকে আলিঙ্গন করা কঠিন। এই স্মৃতিগুলি তিন থেকে চার দশক পুরোনো। পৃথিবী, তথ্যপ্রযুক্তি, মানুষ এবং সর্বোপরি সমাজতান্ত্রিক প্রয়োজনে প্রচুর পরিবর্তন এসেছে। আমাদের প্রচেষ্টা হওয়া উচিত এই স্মৃতিগুলো থেকে মূল্যবোধ বের করে, নতুন প্রজন্মের প্রয়োজনীয়তার উপর ভিত্তি করে সেগুলি তুলে ধরা। বেঙ্গলি এসোসিয়েশন অফ ফিনল্যাণ্ড এর এই বছরের প্রয়াস সেটাই।
আপনাদের সবাই কে জানাই শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা।