বাংলার পটচিত্র

পটোচিত্র বা পটচিত্র হলো এক ধরনের ঐতিহ্যবাহী লোকচিত্রকলা, যা মূলত কাপড় বা কাগজের ওপর আঁকা হয়। “পট” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “পট্ট” মানে কাপড়। এই শিল্পশৈলী ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে প্রচলিত। পটোচিত্রের শিল্পীকে বলা হয় “পটুয়া”।

পটচিত্র কেবল একটি চিত্রশিল্প নয়, এটি চিত্র, সংগীত এবং storytelling-এর এক সুন্দর মিলন। এই শিল্পশৈলী বহু বছর ধরে বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং লোকজীবনের গল্প ধারণ করে চলেছে।পটচিত্রের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীনকালে পটচিত্রই ছিল শিল্পকলার প্রধান মাধ্যম।পটচিত্রের মূল উৎপত্তিস্থল ভারতের ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গ।

কি ভাবে এই পটচিত্র তৈরী হয় সেটা জানো?

পটুয়ারা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে পট তৈরি এবং তাতে রং করেন। পটচিত্রের ক্যানভাস তৈরি হয় তুলো বা সিল্কের কাপড়ের ওপর। এই কাপড়কে তেঁতুলের বীজ থেকে তৈরি আঠা, গোবর ও মাটির প্রলেপ দিয়ে শক্ত করা হয়। তারপর সেটা শুখনো করতো রোদে । শুধু যে পট তৈরি করে তা নয় ওনারা রং ও নিজেরাই বানাতেন তারপর শুরু হতো চিত্রাঙ্কন।

রং তৈরির পদ্ধতি শুনলে আর ও অবাক হয়ে যাবে, সাদা রং শঙ্খের গুঁড়ো বা খড়ি মাটি থেকে, কালো রং প্রদীপের কালি থেকে আবার লাল সিদুরে বা হিংগুল নামে এক ধরনের পাথর, হলুদ হরিতাল, নীল রঙের পাথর বা গাছ থেকে নীল রং তৈরি হতো। এখন যদিও আমরা সব বাজার থেকেই কিনে আনি,তার আবার কত্ত ভ্যারাইটি। তুলি তৈরী হতো বাঁশের কঞ্চির মাথায় পশুর লোম বা কাঠবিড়ালীর লেজের লোম লাগিয়ে।এখন তো শুধু সিনথেটিক তুলি।

মনের মধ্যে নকশা: একজন পটুয়া আঁকার আগে তার মনের মধ্যে পুরো নকশাটি কল্পনা করে নিতেন। কোথায় কী রং হবে, কোন রেখাটি কেমন হবে এসব আগে থেকেই ঠিক করা থাকত। এরপর সেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি সরাসরি পটচিত্র আঁকতেন।

পেন্সিল বা ইরেজার নেই: এখনকার মতো পেন্সিল দিয়ে আগে স্কেচ করা বা ইরেজার দিয়ে ভুল মোছার সুযোগ পটচিত্রে ছিল না। একজন পটুয়াকে তার হাতে তৈরি তুলি দিয়ে সরাসরি কাপড়ের উপর নির্ভুল রেখা টানতে হতো। এর জন্য প্রয়োজন হতো বছরের পর বছর ধরে অনুশীলন (practice) এবং তুলির উপর দারুণ নিয়ন্ত্রণ।

ভুল সংশোধনের সুযোগ সীমিত: একবার রং বসিয়ে দিলে তা পরিবর্তন করা খুব কঠিন ছিল। তাই প্রতিটি রেখা ও রঙের ব্যবহার অত্যন্ত সাবধানে করতে হতো। এটাই এই শিল্পকে আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং এবং অসাধারণ করে তোলে।

এই কারণেই পটচিত্রকে কেবল একটি শিল্পকর্ম বলা যথেষ্ট নয়, এটি একজন শিল্পীর গভীর একাগ্রতা, দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষণ এবং নিখুঁত নৈপুণ্যের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

তোমরা ও একবার চেষ্টা করে দেখতে পারো কোনো গল্পকে এইরকম ছবির মাধ্যমে বোঝাতে পারো কি না। তার জন্য তোমাদের পট বা রং বানাতে হবে না, তোমরা সাধারণ পেপার এই জল রং দিয়ে চেষ্টা করো।
বাংলার পটচিত্রে লোককথা, সামাজিক বিষয়, এবং ধর্মীয় কাহিনি যেমন রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণলীলা বেশি দেখা যায়। বিশেষত, পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের পটুয়া সম্প্রদায় এই শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে এখনো পর্যন্ত। কলকাতার কালীঘাটের পটও এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা উনিশ শতকে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। আধুনিক পটুয়ারা নতুন নতুন বিষয়, সমসাময়িক রাজনৈতিক ঘটনা, পরিবেশ দূষণ, কোভিড-১৯ মহামারী ইত্যাদিও তাদের চিত্রকর্মে অন্তর্ভুক্ত করছেন, যা এই শিল্পকে প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত করে রেখেছে।

বর্তমানে পটচিত্র শুধুমাত্র কাপড়ের ওপর আঁকা হয় না। শাড়ি, টি-শার্ট, ঘর সাজানোর জিনিস, কার্ড ও অন্যান্য স্যুভেনিয়ারের ওপরও এই শিল্পকলা ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় করে তুলছে।