আমরা আন্টার্কটিকা গিয়েছিলাম ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে।আমাদের ২১ দিনেরএই ট্রিপ ছিল, জাহাজে করে। আন্টার্কটিকার সাথে ফ্লকল্যান্ড এবং সাউথ জর্জিয়া দ্বীপপুঞ্জও গিয়েছিলাম এই একই ট্রিপে। জাহাজের শেষ দিন গল্প করছি এমন সময় একজন সবাইকে জিজ্ঞেস করলো “তোমাদের সেরা তিনটে মুহূর্ত, এই ট্রিপের একটুবলো দেখি।” তখন ওই সময় জাহাজের পাঁচ তলার লাউঞ্জে আমরা জনা দশেক মতন ছিলাম। আমি একটু শেষের দিকে পৌঁছেছিলাম ওই দিকে, আগে বেশ কয়েকজন বলে দিয়েছিলো। আমি এসে দাঁড়াতেই একদম কফি উইথ করনের রাপিড ফায়ারের মতনএই প্রশ্ন ধেয়ে এলো।

এইটা ভীষণ কঠিন একটা কাজ শোনালেও আমার কাছে কেন জানিনা খুব পরিস্কার ছিলো। আমরা অনেক অনেক কিছু দেখেছি এই ট্রিপে, অনেক ভালো মুহূর্ত আছে। কাজেই আমি এখন ভাবলে মনে হয় এটা তো আসলে বেশ শক্ত প্রশ্ন হওয়া উচিত, কিন্তু এত সহজে একদম না ভেবেই আমি তো বলে দিলাম বেশ। তবে এখন যদি খুব গভীর ভাবে ভাবিও, উত্তর সেই ওই তিনটেতেই আসছে। হয়তো একদম না কিছু ভেবে বললে একদম ভেতর থেকে কথা বেরিয়ে আসে।

১. রাইট হোয়েল বে, সাউথ জর্জিয়া

লক্ষ লক্ষ পেঙ্গুইন দেখবো জানা আর সত্যি চোখের সামনে দেখা অনেক তফাৎ। আমাদের সাউথ জর্জিয়া দ্বীপের প্রথম ল্যান্ডিং ছিলো এই রাইট হোয়েল বে। জাহাজ থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম গিজগিজ করছে পেঙ্গুইন। তারপর জোডিয়াক বোটে করে চলে গেলাম ল্যান্ডিং সাইটে। জোডিয়াক থেকে নামতেই দেখি বেশ কিছু কিং পেঙ্গুইন একদম স্বাগত করার জন্য এসে দাঁড়িয়েছে। এটা সত্যিই পৃথিবী মনেই হচ্ছে না! কি বলবো! এটা একটা রূপকথা? সত্যি বলতে, আমার রূপকথাও, এত সুন্দর না। কল্পনার থেকেও বাস্তব যেনও আরও বেশি সুন্দর। আমরা হেঁটে আর একটু এগিয়ে গিয়ে যা দেখলাম, তা আমি জীবনেও ভুলবো না। জীবনে এত এত আনন্দ, আমি কি সত্যি কখনো পেয়েছি!! রাইট হোয়েলবে-তে আমরা সেই প্রথম দেখলাম লক্ষ লক্ষ পেঙ্গুইন। চোখের সামনে খেলে বেড়াচ্ছে, কেউ কথা বলছে, কেউ বা ঝগড়া, কেউ আবার দুষ্টুমি করছে। মা বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছে, কোনো মা পেঙ্গুইন আবার সীল-দের থেকে নিজের বাচ্চাকে বাঁচাছে। কত কিছু যেন একসাথে হয়ে যাচ্ছে ! আমি শুধু চেয়েছিলাম, এই সময়টা যেন একটু থেমে যায়। আমি এত উচ্ছাসিত হয়ে গেছিলাম, যে আমি নিজের ইমোশন ধরে রাখতে পারছিলামনা। আমাদের এক্সপেডিশন টিমের whale এক্সপার্ট, Katlyn আমাকে জিজ্ঞেস করলো “How is it? How do feel?” আমি বললাম “I can die happy now! I have nothing more to ask in my life. Nothing can be more beautiful than this!” Katlyn আমাকে একটা সাইড হাগ করে বলল “Aaww… It’s just our first landing in South Georgia and we have many more exciting things to see! But I feel you and I can understand what you mean!” জীবনে হাতে গোনা কিছু সময়ই আমার চোখে জল চলে এসেছে খুশিতে, আনন্দে, এটা তার মধ্যে একটা এবং বিশেষভাবে একটা ।

২. সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বে, সাউথ জর্জিয়া

পরের দিন গিয়েছিলাম সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বে, যেটা এই পৃথিবীর সব থেকে বড় পেঙ্গুইন কলোনী। ধারণা করা হয়, এখানে পাঁচ লক্ষেরও বেশি পেঙ্গুইন আছে। আর এখানেই ছিলো, সেই পেঙ্গুইন নদী। গ্লেসিয়ার থেকে জল আসছে নদীতে আর সেই বরফ গলা জলে পা ভিজিয়ে দুদিকে দাড়িয়ে অজস্র পেঙ্গুইন আর শুয়ে আছে প্রচুর হাতিসীল। এই নদী পেরিয়েই আমাদের যেতে হয়েছিলো সেই কলোনী দেখতে। দারুন রোমাঞ্চকর ছিলো সেই পারাপার, কারণ জলে ভালোই স্রোত ছিলো। একটু হাইক করে, আমরা পৌঁছে গেলাম একদম পাহাড়ের উপরের একটা পয়েন্টে, যেখান থেকে দেখা যায় পুরো কলোনীটা। প্রচুর প্রচুর পেঙ্গুইন। পেঙ্গুইনদের কুম্ভমেলা যেন!! কিং পেঙ্গুইনের বাচ্চাদের খয়েরী পালক থাকে শুরুতে, একজায়গাতে এত বাচ্চা পেঙ্গুইন ছিল যে, খয়েরী একটা নদী লাগছিল। এমন এক জায়গা যেটা আর কারোর সাথে তুলনা হবেই না।

৩. ফয়েন হারবার , আন্টার্কটিকা

এইটা ছিল অ্যান্টার্কটিক পেনিনসুলাতে। কিন্তু এইটা স্পেশাল, অ্যান্টার্কটিকার জন্য না। আমার কাছে এটা টপ তিনে, কারণ এখানে আমরা যা তিমি দেখেছিলাম, অবিশ্বাস্য! এরকম তিমি আমাদের সাথের এক্সপেডিশন টিমও খুব কম দেখেছে। তাদের টপ তিন সাইটিংয়ের মধ্যে একটা সেইদিন। আমার এই ট্রিপে আসার আগে থেকেই, তিমিকে একটু কাছ থেকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। একটা তিমিও যদি দেখতে পেতাম, একদম কাছে, যেমন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি, ওরকম যদি একটু হাম্পব্যাকের লেজ নামছে দেখতাম!! এইআশা নিয়েই গেছিলাম সেদিনের জোডিয়াক বোটে। আড্যাম, আমাদের এক্সপেডিশন টিম-লিডার, আমাদের দশজনকে জোডিয়াকে তুলেই, একদম ছোটালো জোডিয়াক।আর গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল এক জায়গাতে। দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই, চোখের সামনে একসাথে তিনটে তিমি (হাম্পব্যাক), আর কি আওয়াজ তাদের! কি বিশাল! তাদের লেজটাই আমাদের বোটের সাইজের সমান। চোখের সামনে তাদেরকে দেখলাম - মাথা, পিঠ ,লেজ সব। সেই হাম্পব্যাকের তিনটে লেজ একসাথে জলে ডুবলো। আরএই ঘটনা জোডিয়াকে ওঠার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। মনে হলো, আর কি দেখবো! আমিতো একটা চেয়েছিলাম, এত তিন তিনটে! তবে সেদিন ভগবান অনেক-অনেক বড় সারপ্রাইস প্ল্যান করে রেখেছিলেন আমাদের জন্যে। বলে না, ভগবান যখন দেয়, একদম ভরিয়ে দেয়! ঠিক তাই হলো । আর একটু এগোলাম, দেখি আবার অনেক তিমি। এবার পাঁচ-ছয়টা একসাথে। এ কি হচ্ছে, আমাদের সাথে! আমি মনে হয়, একসাথে এতো কুকুর-বিড়ালও দেখিনি, যত তিমি দেখছিলাম। এক সময় আমাদের জোডিয়াকের চারিদিকে অন্তত গোটা পনেরো তিমি তো হবেই। হঠাৎ দেখি, একটা তিমি আবার একদম আমাদের বোটের তলা দিয়ে যাচ্ছে! ওরে বাবা রে! কি বিশাল তার সাইজ!! রোমাঞ্চ, ভালো লাগা, ভয়, আনন্দ, খুশী সব ইমোশনের মিক্স করে যেন ছেঁচড়া হয়ে গেছে! কি যে অনুভব করছিলাম, এটা লেখা অসম্ভব। সেদিন সব মিলিয়ে দুঘন্টাতে আমরা একশোর ওপর তিমি তো দেখেইছি। প্রথমদিকে গুনছিলাম, তারপর ষাট হয়ে যেতে, পরের দিকে আর গোনাগুনি রেখে, ক্যামেরাও রেখে, শুধু দুচোখ ভরে তাদের শো দেখেছি। এই দিন তো আমার জীবনে আর আসবে না, এটা থেকে কিছুটা সময় তো তাই একদম শুধু নিজের জন্য রাখাই যায়। যার ভাগ আর কাউকে দেবো না, শুধু নিজের। আর এরপর বলবো, ছোট থেকেই হিরো বলতে আমি শাহরুখ খানের ফ্যান, তাকেই বুঝি, আর একটু বড় হতে রণবীর কাপুরকে ভালো লাগত। লাগতো বললাম কারণ এখন এরপর থেকে আমার কাছে একটাই হিরো! এই তিমি!!

৪. বাড়তি একটি মুহূর্ত

চার নম্বর বলার সুযোগ পেলে বলতাম প্রথম আন্টার্কটিকাতে পা রাখা। কারণ এই আন্টার্কটিকা অভিযান আমাদের কাছে ছিলো, যেন বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাবার মতন। ছোট থেকে এটাই ভেবেছি, ওটা লোকে এক্সপেডিশনে যায়। আমরা সেখানে যাব, ভাবিই নি, দুঃস্বপ্নেও না! তাই প্রথম পা রাখা এই বরফ মহাদেশে, অনুভূতিটাই আলাদা! তবে আমাদের পা রাখার সপ্তম মহাদেশ না! এটা ছিলো ষষ্ঠ। অস্ট্রেলিয়া এখনও বাকি আছে।

তারিখ: ডিসেম্বর ২০২৪
স্থান: এন্টার্কটিকা