একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসীমার অন্তর্ভুক্ত আধুনিক কালের মানুষের জন্যে মোট প্রজনন হার ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সম্পর্কটা বেশ জটিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নির্ভর করে মোট প্রজনন হার, জন্মহার, মৃত্যুহার, অভিবাসন, দেশত্যাগ বা প্রবসন, মানুষের গড় আয়ু ইত্যাদি বহুবিধ উপাদানের (ফ্যাক্টর) উপর। তবে সহজভাবে মোট প্রজনন হার ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের (total fertility rate- TFR and population growth - PG ) সম্পর্কটাকে দেখার জন্যে বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত পরিসংখ্যানের উপর নির্ভর করা যেতে পারে।
আমার এ আলোচনাটা সীমাবদ্ধ থাকবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপরোল্লিখিত দুটি (মোট প্রজনন হার ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার) সূচক এর তুলনামূলক ব্যাখ্যায়। এ ব্যাপারটা সহজ করে ব্যাখ্যা করার জন্যে এ নিবন্ধে বিভিন্ন দেশের মোট প্রজনন হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ভিত্তিতে একটা সারণী (table বা list ) ও তার ভিত্তিতে একটা লেখচিত্র (Graph ) তৈরী করা হয়েছে। এ তথ্য গুলোর উৎস হচ্ছে United Nations Population Fund (মোট প্রজনন হার) ও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের CIA World Factbook. এ দুটি সূত্রই যথেষ্ট নির্ভরশীল বলে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা দ্বারা স্বীকৃত।
এখানে একটা জিনিস বলে রাখা উচিত যে উদ্ধৃত দেশগুলোর TFR সূচক ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের TFR এর কাছাকাছি। মোট প্রজনন হারের (TFI rate) মান ১.৪ থেকে ১.৯ নেয়া হয়েছে। যদিও অনেকেই জানে মোট প্রজনন হার বলতে কি বুঝায়, তবুও সহজ কথায় এর মানে হচ্ছে একজন মহিলা গড়ে কতজন সন্তানের জন্ম দেন। এ সংখ্যাটা নির্ভর করে বিভিন্ন আর্থ- সামাজিক উন্নয়নের পরিমাপের উপর। সব দেশেই এ সূচকটির পরিবর্তন হয় আর্থ -সামাজিক উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সাথে মোট প্রজনন হার নিম্নগামী হয়।
পশ্চিমবঙ্গকে এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে নেয়ার কারণ হচ্ছে এই যে, একই স্তরের মোট প্রজনন হার যে সব দেশে বিদ্যমান, সেগুলোর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সাথে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের একটা বড় রকমের গরমিল দেখা যাচ্ছে। এ গরমিলটার কারণ উদ্ঘাটন করা নিশ্চিতভাবে প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী বাংলাদেশের এ দুটো সূচক পশ্চিমবঙ্গের সাথে অত্যন্ত পরস্পরবিরোধী হওয়ায় এ ব্যাখ্যার জন্যে বাংলাদেশের এ সূচক গুলো ও উল্লেখ্য।
উদ্ধৃত সারণিতে দেখা যাচ্ছে মোট প্রজনন হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। আমি এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের শুধুই ধনাত্বক মানগুলো নিয়ে কাজ করবো। ঋনাত্বক বৃদ্ধির হারের ব্যাখ্যাও দেয়ার চেষ্টা করবো। ধনাত্বক হার যদি খুবই উচ্চ হয়, তবে সেটাকেও এ ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হবে না, তার কারণটাও ব্যাখ্যা করার প্রয়াস থাকবে।
এখানে উদ্ধৃত দুটো সারণি (Table ১, ২) ও লেখচিত্র (গ্রাফ ১, ২) মনোযোগ দিয়ে দেখলেই মোট প্রজন হার ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের গরমিলগুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথম সারণিতে উদ্ধৃত পরিসংখ্যানগুলো দেখাচ্ছে যে ১.৯ মোট প্রজনন হার সম্পন্ন দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৩৯% থেকে ০.৮৯% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে শ্রীলংকার বৃদ্ধি ০.৩৯ হওয়ার কারণ সম্ভবতঃ এ দেশের অপেক্ষাকৃত উচ্চ প্রবসন (emigration)হার। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মোট প্রজনন হার ১.৯ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৮৯%.
বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করছে মোট প্রজনন হার ১.৬ সম্পন্ন দেশগুলো। এখানে একই TFR হওয়া সত্ত্বেও আর্মেনিয়া, বুলগেরিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, স্লোভাকিয়া ও স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ঋনাত্বক (Negative). এর প্রধান কারণ হচ্ছে এ দেশগুলো থেকে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ১৯৯০ এর দশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর কাজের সন্ধানে পশ্চিম ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে তো অন্যান্য উন্নত দেশে ক্রমাগত প্রবসিত (emitrated ) হচ্ছে । তাছাড়া বিশ্বায়নের (Globalization) ভূমিকাটাও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। আবার অস্ট্রেলিয়াতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.১৩%, যদিও এখানে মোট প্রজনন হার ১.৬। এর প্রধান কারণ হচ্ছে অভিবাসন (ইমিগ্রেশন - immigration); অস্ট্রেলিয়া প্রতি বছর সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক বিদেশিদের অভিবাসন দিয়ে থাকে। সংখ্যাটা কখনো বেশি, কখনো বা কম। সেটা নির্ভর করে তাদের অর্থনীতির প্রয়োজনের উপর।
এবার আসা যাক মোট প্রজনন হার ১.৪ সম্পন্ন দেশগুলোর জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে। এখানে পর্তুগাল ও গ্রীস এর ঋনাত্বক বৃদ্ধির হারের কারণ প্রবসন (Emigration) ও বিশ্বায়ন (globalization). লুক্সেমবুর্গের ১.৫২% বৃদ্ধির মূলে আছে অভিবাসন। এখানকার জনগণের প্রায় ৪৭% (অর্ধেক) অংশ বিদেশী বংশোভূত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রায় ৮০% হচ্ছে বিদেশী বংশোদ্ভূতদের কল্যাণে। এখানেই আছে পশ্চিমবঙ্গ। TFR ১.৪ হওয়া সত্বেও পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০,৯৮%, অথচ একই TFR সম্পন্ন দেশ ফিনল্যাণ্ড এর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.২% , যা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় পাঁচগুণ কম।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশে TFR ১.৯ এর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে ০,৮৯%, যা স্বাভাবিক।
আর পশ্চিমবঙ্গে TFR ১.৪ এর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৯৮%, যা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
পশ্চিমবঙ্গের এ অস্বাভাবিক উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের কারণ নিশ্চিভাবে অভিবাসন (Immigration), সেটা পাশের রাজ্য থেকেই হোক আর পাশের দেশের থেকেই হোক। যেহেতু ভারত সরকারের বিদেশ থেকে অভিবাসনের (Immigration) কোনো প্রকল্প আছে বলে শোনা যায় নি, তাই কোনো বিদেশ থেকে অভিবাসন নিশ্চয়ই আইনি পথে নয়।
এ নিবন্ধে উদ্ধৃত Table ও graph গুলো স্ব-ব্যাখ্যামূলক (self explanatory ); এগুলো বুঝতে কারো কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। যারা বাংলা হরফে লেখাটা পড়তে পারবেন না, তারা Table ও graph দেখে সহজেই বুঝতে পারবেন। প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
Table ২ এর পরিসংখ্যানের উৎস হচ্ছে Table ১ এর হলদে রাঙ্গানো বৃদ্ধির হার গুলো। গ্রাফ ১ টাতে একই TFR সম্পন্ন দেশগুলোর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভিন্নতার কারণগুলো উপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাই গ্রাফ ২ তে এ দুটো সূচক (TFR and population growth) এর পারস্পরিক সম্পর্ক অতি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।
পরিশেষে বক্তব্য হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৩% থেকে ০.৫% এর মধ্যে থাকা উচিত। তা না হয়ে সংখ্যাটা যখন দু-তিন গুণ বেশি হয়, তখন সেটা নিশ্চয়ই চিন্তার কারণ হওয়া উচিত।