নমস্কার সুধীবৃন্দগণ। আমি আবার এসে গেছি, নিজের ঝুলি থেকে কিছু জ্ঞান বিতরণ করার জন্য। আবার সেই হুকুম জারি করা হয়েছে আমাকে কিছু কথা বলার জন্য।

আজকাল চারিদিকে এত সংঘাত, এত কলহ যে ভাবলাম ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’ বা ‘স্বার্থের সংঘাত’ নিয়ে কিছু বলি।

পেশায় গবেষক হওয়ায়, এই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট এর সহিত আমাকে প্রায়শই সম্মুখীন হতে হয়। নিজের গবেষণার নতুন তথ্য ছাপতে হলেই, আমাদেরকে ঘোষণা করতে হয় যে ‘The authors declare no conflict of interest’। তার মূল কারণ আর কিছুই না, আপনাদের যতই একে অপরের সঙ্গে মতবিরোধ বা মনে মনে সংঘাত থাকুক না কেন, যেহেতু কোনো না কোনো ভাবে আপনারা কোনো না কোনো গবেষণায় একে অপরের পরিপূরক, সুতরাং না চাইলেও আপনাদের এই মন্তব্য করতেই হবে। আর যদি এটা থেকে রেহাই পেতে চান, তাহলে একক ভাবে গবেষণা ছাপুন; তখন নো কনফ্লিক্ট, ওনলি ইন্টারেস্ট।

আর এই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট হবে নাই বা কেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিমুহুর্তে এটি কোথাও না কোথাও, কোনো না কোনো ভাবে সদা বিরাজমান।

দোষ আর কি বলুন? রক্তে তো ১৬ আনা বাঙালিয়ানা, তাই নিজ স্বার্থের জন্যই হোক বা পরিবারের স্বার্থের জন্যই হোক, এই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট আমাদের চলতেই থাকবে। ছোটবেলায় এটির সঙ্গে আমাদের হাতেখড়ি হয় আমাদের অভিভাবক দের সহিত। স্বার্থের জন্য যত আবদার ও যেমন তাদের ঘিরে, আবার সেই স্বার্থের জন্যেই যত কনফ্লিক্ট ও কিন্তু তাদের সহিত আমাদের হয়ে থাকে।

আসুন, এবারে কিছু কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টের উদাহরণ দি তাহলে, যেগুলো কনফ্লিক্টেড হয়েও আমরা সেগুলো কে মেনে নিয়েছি।

কিছুটা, ঘটি-বাঙাল এর কনফ্লিক্ট আর কিছুটা অন্যান্য বিষয় নিয়ে। Ancestorship সুত্রে বাঙাল এর অধিকারী হলেও, জন্মসূত্রে আমি কিন্তু ঘটি। মানে বলতে চাইছি যে আমার পূর্বপুরুষরা বাঙাল হলেও, আমার জন্ম কলকাতাতেই, তাই জন্মসূত্রে ঘটি। আর এ নিয়েই যত কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট। কিছুতেই বুঝতে পারি না যে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক।

ছোটবেলা থেকেই আমাদের পরিবার একটু নোন্তা, একটু ঝাল-ঝাল খাওয়াতে বিশ্বাসী, তবে মাঝেসাঝে ডালের অম্বল, আলু-পোস্ত হলে খাওয়াটা যে একেবারেই মন্দ হত না, তা বলা বাহুল্য। তবে, রান্নায় চিনি বা মিষ্টি পরলেই মটকা গরম হয়ে যায় এক্সসেপ্ট চালকুমড়া দিয়ে মুগ ডাল, আমার দিদা খুব ভালো রান্না করত এই পদটা। যাক যে যাক বাঙালি হয়েও, মাছ মোটেই আমার প্রিয় না, কিন্তু পাতে ইলিশ বা চিংড়ি যেটাই পড়ুক না কেন, শুধু মনটাই নয়, পেটটাও যে কি পরিমানে উৎফলিত হয়ে উঠত সেটা খালি আমিই বুঝতে পারতাম।

কথায় বলে যে সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল। তা এই ফুটবল খেলাটি, আর কিছু কিছু খেলোয়ারদের কে নিঃসন্দেহে ভালো লাগলেও, টিম হিসাবে মনে প্রাণে ইস্টবেঙ্গল। এটা বলতে পারেন একেবারে বাপ-ঠাকুরদা থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত । এখানে only ইন্টারেস্ট আর পুরোটাই কনফ্লিক্ট উইথ মোহনবাগান। আরেকটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট যেটা আমাদের ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় তা হল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে ঘিরে। যদিও বা দু দলের সঙ্গে ভারতীয় হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, কিন্তু আমরা বাঙালি ফুটবল প্রেমীরা হেরিডিটারি সূত্রে এই কনফ্লিট টা অর্জন করেছি। যারা পেলে ম্যাজিক দেখে আর শুনে বড় হয়েছে, তারা হলো আমাদের একটু আগের জেনারেশন আর আমরা বড় হয়েছি মারাদোনার স্কিল দেখে। কিন্তু ওই যে বললাম কিছুটা হেরিডিটরি, তাই এডসন আরান্তেস ডো নাসিমেন্টো বা পেলে, এই আমার কাছে ফুটবলের ভগবান। যদিও বা ইদানিং আমি মেসি ভক্তও হয়েছি। আর কনফ্লিক্টটা এখন পেলে-মারাদোনা থেকে শিফ্ট হয়ে মেসি-রোনাল্ডো তে ঠেকেছে।

আরো অনেক ক্ষেত্রে আমরা এই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্টে দেখে থাকি। যেমন ধরুন বাংলা চলচ্চিত্রে উত্তম কুমার না সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়, এই বিবাদ সর্বদা বিদ্যমান। আমাদের বাবা-মা দের জেনারেশন এর অনেকেই উত্তম কুমারের অন্ধ ভক্ত, এতটাই যে তিনি মহানায়ক বলেও খ্যাত। কিন্তু অন্যদিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গুণমুগ্ধদের সংখ্যাও কম নয়। অথচ যতই আমরা এনাদের নিয়ে মতবিরোধ প্রকাশ করি না কেন, অনেকেই শুনলে অবাক হবেন যে মোট ৯টি ছবিতে, উত্তম বাবু এবং সৌমিত্র বাবু একসঙ্গে অভিনয় করেছিলেন। সেই ঝিন্দের বন্দী দিয়ে শুরু ১৯৬১ সালে, তারপর ‘স্ত্রী’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘পঙ্খীরাজ’, ‘দেবদাস’, ‘অপরচিত’, ‘নকল সোনা’, ‘যদি জানতেম’ এবং ‘প্রতিশোধ’ দিয়ে শেষ।

এই সৌমিত্র বাবুর প্রসঙ্গেই উঠে আসে ফেলুদার নাম। এখানেও কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট, ফেলুদা না ব্যোমকেশ। প্রথমজন সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি আর পরেরজনের রচয়িতা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়। আমি মনে করি ব্যোমকেশের হাত ধরেই প্রদোষ মিত্তিরের বা ফেলুদার জন্ম। ব্যোমকেশ নিজেকে সত্যানেস্বী মনে করতেন, ওদিকে ফেলুদা একটু ডায়নামিক, ঠিক অনেকটা জটায়ুর প্রখর রুদ্রর মতন একজন ডিটেক্টিভ। ব্যোমকেশের অনেক গল্পে দোষীদের সাজা না হয়ে বরং তাদেরকে ছেড়ে দিতে দেখা গেছে কিন্তু ফেলুবাবুর প্রত্যেকটি গল্পেই দোষীদের শাস্তি অবধারিত।

আর যখন সত্যজিৎ রায়ের কথাই এল, তাহলে তো ঋত্বিক ঘটক আর মৃনাল সেনের প্রসঙ্গ আসবেই। অবশ্য, এখানে হয়ত কোনো কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট হবে না কারণ এনারা তিনজনেই সর্বকালের সেরা বাঙালি পরিচালক। ঋত্বিক ঘটক যেমন আমাদের কালজয়ী সিনেমা উপহার দিয়েছেন: অজান্ত্রিক, মেঘে ঢাকা তারা, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ইত্যাদি, ঠিক তেমনই মৃনাল সেনের ভুবন সোম, মৃগয়া, পদাতিক, এক দিন প্রতিদিন আজও আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ যখন প্রথম দেখি, আমি শুধু মুগ্ধ হইনি, হতবাক হয়েছি যে কতটা পুঙ্খানুপুঙ্খু ভাবে তিনি গ্রাম বাংলার চিত্রটি তুলে ধরেছিলেন। তারপর একের পর একের হিট, সে গুগাবাবাই হোক আর মগনলাল মেঘরাজ ই হোক না কেন, সব রকমের মানুষের জন্যই তিনি ছায়াছবি করে গেছেন। এই প্রসঙ্গে আরেকজনের কথা উল্লেখ না করলে লেখাটা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকবে, তিনি হলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। এটা নাকি বলতে শোনা যায় যে মহিলাদের মনকে এত নিখুঁত ভাবে তার মতন করে অন্য কোনো পরিচালক বুঝতে পারেন না। সেই জন্যই তার ছবিতে নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। আর বলা বাহুল্য যে বর্তমান সময় এটি কতটাই প্রাসঙ্গিক। ১৯৯২ সালে ‘হীরের আংটি’ থেকে শুরু হয়ে ২০১৩ এর ‘সানগ্লাস’ অবধি জার্নি ছিল অতুলনীয়। তা এই চারজনকে নিয়ে যতই কনফ্লিক্ট থাকুক না কেন, এনারা না হলে চলচ্চিত্রের মানচিত্রে, বাংলার নাম কোনোদিনই উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হত না।

মোদ্দা কথা হল যে, আমরা বাঙালিরা কনফ্লিক্ট ছাড়া বাঁচতেই পারব না, আর যেখানেই কনফ্লিক্ট সেখানেই কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট ও আসবে। এখন এটাকে ঠিক কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বলা হবে না কনফ্লিক্ট আউট অফ ইন্টারেস্ট বলা হবে, সেটা আমি পাঠকদের ওপরই না হয় ছেড়ে দিলাম। এটা না, অনেকটা সেই কফি-টফি র বিজ্ঞাপনটার মতন, ও বলে কফি তো সে বলে টফি এন্ড দা ওয়ার কন্টিনিউস।

আরেকটা কথা একেবারে না বললেই নয়, সেটি হল ‘হিন্দুস্তানি’ নামক শব্দটার ব্যবহার। এই শব্দটির মধ্যে কোনো কনফ্লিক্ট থাকাই উচিত নয়, তার কারণ আমরা ভারতীয়রা সবাই ‘হিন্দুস্তানি’। কিন্তু তাও বাঙালীরা এটিকে অবাঙালীদের সঙ্গে পার্থক্য হেতু বা কনফ্লিক্ট অফ ভাষা এবং সংস্কৃতি যাতে না হয়, সেই কারণে শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। এটি সাধারণত বাঙালি মায়েদের নানান কথা প্রসঙ্গে ব্যবহার করতে দেখা যায়। যেমন ধরুন, ‘ও তো একটা হিন্দুস্তানি’, ‘তুই ওই হিন্দুস্তানিদের পাড়ায় গিয়েছিলি?’, ‘না না, বাবা ওই দিক দিয়ে যাব না, ওখানে সব হিন্দুস্তানিগুলো থাকে’ ইত্যাদি। এইসব কথায় পারলে এক্ষুনি চরম কনফ্লিক্ট শুরু হতেই পারে কারণ বর্তমানে, যেহেতু সব জায়গায়ই ধীরে ধীরে কসমোপলিটান হয়ে যাচ্ছে, সেহেতু এই শব্দটির পরিত্যাগ করাটা আমার মতে অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাও বলবো, যখন মা এই শব্দটির উচ্চারণ করে থাকে, তখন ইচ্ছে না থাকা সত্বেও, মন্দ ও লাগে না। খালি মনে হয় যে হয়তো এরকম সরল ভাবে ‘হিন্দুস্তানি’ শব্দটা আর পরের জেনারেশন বলতে পারবে না।

যাই হোক, এবার তাহলে শেষ করি, ওই বলে না, ‘আমার কথাটি ফুরোলো নটে গাছটি মুড়োলো’। অনেক হ্যাজালাম কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট নিয়ে।

শেষে একটা কথাই বলে যেতে চাই, যে আলোচ্য বাক্যাংশটি অফিসিয়াল ডকুমেন্টস এই শোভা পায়ে, দৈনন্দিন জীবনে যতই প্রতিদিন-প্রতিপদে এর সম্মুখীন হই না কেন, এই স্বার্থের সংঘাত না থাকাই ভালো।