গণ মাধ্যম হিসাবে চলচ্চিত্রের ভূমিকা খুবই শক্তিশালী। সেই কারনেই পৃথিবীতে যে কোনো শক্তির আধার চলচ্চিত্রকে নিজেদের বক্তব্য ছাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে। এই ধরণের গণ মাধ্যমের সুবিধা হলো এক্ষেত্রে বিনোদনের মোড়কে কথক তার বক্তব্যকে পৌঁছে দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রান্তিকতম দর্শকের কাছেও পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। সেই কারণেই চলচ্চিত্র আসার আগে থেকেই বিনোদনের প্রধান মাধ্যম মঞ্চ নাটক বা খোলা মঞ্চের যাত্রাপালাতেও বিনোদনের সাথে সাথে কিছু সামাজিক বা রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হতো।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কালে মধুসূদন দত্ত বা দীনবন্ধু মিত্রের লেখা নাটকগুলি জনপ্রিয় হয়েছিল। নীলদর্পণ নাটকের তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী বক্তব্যের জন্য একদিকে যেমন এই নাটক ও তার নাট্যকার ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পরে তেমনি মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ও জন্ম দেয়। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটকের সফল মঞ্চায়ন বাঙালি জাতি সত্ত্বার জাগরণ ঘটায়। ১৯৯৩ সালে নির্মিত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র রাজা হরিশ চন্দ্র ব্রিটিশ অত্যাচারী রাজের প্রতিপক্ষ হিসাবে সনাতন দয়াশীল ভারতীয় রাজতন্ত্রকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এই প্রয়াস অবশ্যই জাতীয়তাবাদী ইচ্ছার প্রকাশ।

ঔপনিবেশিক বাতাবরণে জাতীয়তাবাদী সিনেমা বানানোর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল ঔপনিবেশিক নজরদারি। স্বাধীনতার পর নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে সংঘবদ্ধ সংগ্রামের গৌরব কাহিনী তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। দেশ ভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা, দারিদ্রতায় দীর্ণ দেশবাসীর কাছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ই ছিল মূল অনুঘটক। এই বাতাবরণে ১৯৪৭ সালে নির্মিত সতীশ দাশগুপ্ত পরিচালিত পথের দাবী, ১৯৪৯ সালে দেবী চৌধুরানী, ১৯৫১ সালে আনন্দমঠ, ১৯৭৭ সালে সব্যসাচী নির্মিত হয়। ১৯৪৯ সালে নির্মিত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন চলচ্চিত্রের শেষ অংশে মাস্টারদার নশ্বর শরীর আকাশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আর সেখানে ভেসে আসছে স্বাধীন ভারতের পতাকা। অর্থৎ স্বাধীনতা সংগ্রামের আবেগের সাথে নতুন স্বাধীন ভারত কে মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৫১ সালে নির্মিত হেমেন গুপ্তের ১৯৪২ চলচ্চিত্র টি জাতীয়তাবাদী ভাবনা জাগরণে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলো।

আধুনিক কালের বাংলা চলচ্চিত্রের প্রধান মুখ সত্যজিৎ রায়। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অশনি সংকেত সিনেমাতে ৪৩; এর মন্বন্তরে র প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ বাংলার আর্থসামাজিক পট পরিবর্তনের চিত্র দর্শকে উপনিবেশিক শাষণ এ প্রান্তিক মানুষের দুরাবস্থার সাথে একাত্ম বোধ করতে বাধ্য করে।

১৯৬০ সালে ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত মেঘে ঢাকা তারা একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র। স্বাধীনতা পরবর্তী উদ্বাস্তু সমস্যা ও সিনেমার মূল চরিত্র নীতা র হাহাকার “দাদা আমি বাঁচতে চাই” দর্শকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তেমনি সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের রাজকাহিনী একেবারে অন্য আঙ্গিকে দেশভাগ ও জাতিয়তাবাদকে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। সেখানে বারবণিতাদের ও যে দেশ নিয়ে নিজস্য আবেগ আছে সেই ভাবনাকে তুলে ধরা হয়েছে।

বলিউড সিনেমাতে লাগান, ভাগ মিলখা ভাগ ইত্যাদিতে খেলার মধ্যে দিয়ে স্বদেশ বোধ জাগ্রত করার কাহিনী থাকলেও বাংলাতে এমন সিনেমা খুব একটা নেই। অরুন রায় পরিচালিত এগারো সিনেমাতে ১৯১১ সালে মোহনবাগান দলের ব্রিটিশ গোড়া খেলোয়াড়দের সাথে ফুটবল খেলে IFA শিল্ড জেতার গল্প আছে। ভারতীয় খেলোয়াড় রা খালি পায়ে খেলে জিতেছিল। যে সিনেমার tagline হচ্ছে ফুটবল পায়ে স্বাধীনতার লড়াই।

এই ভাবে দেশে বিদেশে বিভিন্ন ভাষায় সিনেমা অনেক বার্তা বিনোদনের মোড়কে আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়।