সেবার পুজোয় আমি কলকাতায়। পঞ্চমীর বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডার প্ল্যান তাই অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। U N Brahmachari রোড থেকে ট্যাক্সিটা বেশ তাড়াতাড়ি শরত বোস রোড এ চলে এলো। অনেক্ষন থেকেই বৃষ্টিটা টিপ্ টিপ্ করে হয়ে চলেছে। জানলা দিয়ে বৃষ্টিভেজা কলকাতা আর তারসাথে পুজোর জাঁক জমক আর ব্যস্ততাটা বেশ উপভোগ করছি ঠিক তখনি একটা বিরাট জ্যাম এ ফেঁসে গেলো ট্যাক্সিটা। বিহারি অল্পবয়েসী ছেলেটা স্টিয়ারিং থেকে হাত টা সরিয়ে পাশের গামছাটা মুখে বারকয়েক বুলিয়ে নিলো। একটা হালকা প্যাচপেচে গরম রয়েই গেছে। এখন বেশ কিছুক্ষনের দায়ে আটকে গেলাম মনে হচ্ছে। মনে মনে নিজের কপালটাকেই দায়ী করে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ড্রাইভার ছেলেটির সাথে মুজাফ্ফরপুর এ ওর খেতিবাড়ির গল্প শুরু করে দিলাম। সময়টা কাটাতে হবে তো।

হটাৎ জানলার কাছে টোকা শুনে তাকিয়ে দেখি দুটো ছোট ছোট ময়লা হাত, ঝুঁকে নিচের দিকে তাকাতে পুরোটা দেখতে পেলাম। বছর পাঁচ ছয়েকের একটা বাচ্চা মেয়ে, সারা গায়ে নোংরা মাখা, চুল ভর্তি জট। গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন ফ্রক কোনোরকমে লেগে আছে। কাঁধে একটা ব্যাগে কয়েকটা জাপানী হাতপাখা নিয়ে সিগন্যালে বিক্রি করছে। বৃষ্টিতে বেচারি খুব ভিজে গেছে। মুখটা কাঁচু মাচু দেখলে মায়া হয়। আমার পাখার দরকার নেই তাই হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলাম এগিয়ে যেতে। মেয়েটার মনে হয় সকাল থেকে একটাও বিক্রি হয়নি। আমার দিকে একটা শুন্য দৃষ্টি দিয়ে সামনের ট্যাক্সিটার দিকে এগিয়ে গেলো। পুজোর দিনে বাচ্চাটাকে খালি হাতে ফেরাতে খারাপই লাগলো। আজ পেটে কিছু পড়েছে কিনা কে জানে !

বাইরে দিনের আলো এবার আস্তে আস্তে কমে আসছে। পঞ্চমীর সন্ধ্যে টা আরও জমে উঠছে। একটু দূরে একটা ট্রাকে করে মা চলেছেন তাঁর ছেলেপুলেদের নিয়ে প্যান্ডেলে। পঞ্চমীর ঢাক বাজছে একনাগাড়ে। পুলিশ ভিড় সামলাতে হিমশিম।

সামনের ট্যাক্সির ভদ্রলোক মানুষটি মনে হয় ভালো। মেয়েটার থেকে একটা পাখা কিনলেন। হাতে টাকাটা ধরে মেয়েটা রাস্তার ধারে সরে গেলো। যাক বাবা আমার মনটা একটু ভালো হল। বৃষ্টিটা এবার একটু ধরে এসেছে, এদিকে ট্রাফিক মোটে নট নড়ন চরণ। ড্রাইভার একটু নিরাশ হয়ে চুপ করে গেছে। আমি আবার মেয়েটির দিকে নজর ঘোরালাম।

পুজোর জন্যে রাস্তার দুপাশে নানান রঙের টিউব টুনি কত কি। এক ইঞ্চি অন্ধকার থাকার যো নেই কোথাও। এই শহর চিনতে পারা যায়না ঝট করে। একটা মায়াবী সবুজ আলো পড়েছে মেয়েটার মুখে। একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। একবার নিজের কামাই এ খুশি হয়ে হেঁসে উঠছে আবার হাতের টাকাটা দেখছে অবাক হয়ে। হিসেব মিলছে না। ভদ্রলোক বোধ হয় একটু বেশি টাকাই দিয়েছেন। ওর কাছে এ অনেক। আমার বড়ো মেয়েটা হাতে টাকা পেলে MacD খোঁজে, Marabou খোঁজে। ছোটটা সাত, টাকা ব্যাপারটা এখনো বোঝেনা। এই বাচ্চাটা আরেকটু ছোট, টাকা গুনতে পারে? ওরও কি কোনো শখ আছে, ঠাকুর দেখে? নাকি ওদের কাছে যেভাবে হোক বেঁচে থাকাটাই একমাত্র শখ?

এবার ট্রাফিকটা একটু নড়ে উঠলো। সবাই ইঞ্জিনে স্টার্ট দিচ্ছে। যাক দুগ্গা দুগ্গা বলে এবার চলো তো বাবা। এখনো টেনে চালালে সন্ধ্যের আড্ডাটা মিস হবেনা।

এমন সময় রাস্তার পাশ থেকে একটা চাপা আয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি বাচ্চাটা তীরের গতিতে আগের চলন্ত ট্যাক্সিটার জানলাটা তাক করে ধেয়ে আসছে। পথচারীরা ঘাবড়ে গেছে বাচ্চাটাকে ট্রাফিকের দিকে দৌড়োতে দেখে। বৃষ্টি থেমে গেছে বলে কাঁচটা নামানোই ছিল বোধহয়। আরেকটা পাখা টিপ্ করে জানলা দিয়ে ছুড়ে দিয়ে আবার দৌড়ে সরে গেলো সে। ভদ্রলোক ভীষণ অবাক হয়ে জানলা দিয়ে কিছু বলতে যাচ্চিলেন কিন্তু তাঁর ট্যাক্সিটা তখন বেশ গতি নিয়ে নিয়েছে। আমি খালি তাঁর হাতটা দেখতে পেলাম। ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করছেন ‘কেন’ ? বাচ্চাটা দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে হাসছে। খুব খুশি। ভদ্রলোকের দেয়া উপরিটা সে নেইনি। আরেকটা পাখা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে হিসেব মেলাতে পেরেছে।

ছোট্ট ময়লা মাখা অভুক্ত দেহটা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায় ড্রাইভার বেশ স্পিড তুলেছে। চারিদিকে শশব্যস্ত কলকাতা আর পুজোর হইচই এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে এই প্রশ্নটাই বারবার ঘুরে ফিরে আসছিলো মনে - ‘কেন’. কেন করলো এরকম মেয়েটা? এটা কি ওর আত্মসম্মান? ও টুকু একটা শিশু যার জীবন শুরু হয়েছে রাস্তায় শেষও হবে রাস্তায়, বাবা মা ঠিক কে, তাই হয়তো জানেনা— কে দিলো তাকে আত্মসম্মানের এই শিক্ষা?

বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। খুব সামান্য এই পুজোর ঘটনাটা মনে থেকে গেছে। আজও শরৎ বোস রোডের ওই জায়্গাটা দিয়ে গেলে ভিড়ের মধ্যে আনমনে সেই মুখটা খুঁজি। উত্তরটা যে আজও অজানা।