স্যার যে নামের পরে পদবিটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন সেটা বদ্রু প্রথমে বুঝতে পারেনি।
যখন বুঝতে পারলো তখন পেছন থেকে নারান চাপা গলায় বলে উঠলো -'স্যার ওর পদবি নেই।'
সঙ্গে সঙ্গে হাসির আওয়াজে ভরে উঠলো ক্লাস ৬ এর ব্লাসরুম।
স্যার কিছুক্ষন বোকার মতো হেসে বদ্রুর দিকে তাকিয়ে বাকি রোল কল এ মন দিলেন।
বদ্রু সিট এ বসতে বসতে ভাবলো এই নতুন স্যার একটু অন্যরকম , আগে একবার হেডস্যার বলেছিলেন যে একটা মানুষের নামটাই যথেষ্ট - পদবির কোনো দরকার নেই।

সুল শেষে বদ্র ভেবেছিলো কথাটা অতনুর সঙ্গে আলোচনা করবে।
কিন্তু অতনু আগেই চলে গেছে আজ।
পুজোর ছুটির আগে আজ শেষ ফুলের দিন - তাই প্রায় সব ছেলে মেয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে।
অতনু বদ্রুর সব থেকে কাছের বন্ধু ।
যদিও বদ্রুরা গরিব কারণ বদ্রুর বাবা চালকলে মিস্ত্রির কাজ করে আর মা বাড়ি বাড়ি ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ করে।
সেদিক থেকে অতনুর অনেক বড়োলোক বদ্রুর মতে, ওর বাবা একটা সরকারি অফিসে কেরানির কাজ করে, ওদের বাড়িটাও বেশ বড়।
কিন্তু কে জানে কেন বদ্রুর মত অনেক ছেলে থাকা সত্তেও অতনুর সঙ্গেই ওর জমে ভালো।

কুল এর ছুটিতে কি কি করবে এই ভাবতে ভাবতে বদ্রু স্টেশন এর পাশে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে বাড়ির পথে এগোলো।
শরৎ এর পরিষ্কার আকাশ তখন আন্তে আস্তে বিকেল থেকে সন্ধের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে।

আজ মহাষষ্ঠী।
বদ্রুদের বাড়ির আসে পাশে চারদিক গমগম করছে।
মাইক এ গান হচ্ছে, প্যান্ডেল থেকে লোকজনের আওয়াজ ভেসে আসছে। সবার ভেতরেই আনন্দ আর ব্যাত্ততা মিশে একসাথে উপচে পড়ছে।
দেখে মনে হচেছ প্রায় সবার গায়েই নতুন জামা কাপড়।
মাবাবা বেরিয়ে যাওয়ার পরে বদ্রু কিছুক্ষন পড়াশোনা করেছিল, কিন্তু তারপর মায়ের করা জলখাবার না খেয়েই এখন রাততায় হাটতে বেরিয়েছে তার গায়ে নতুন জামা নেই, সেই পুরোনো একটা হাফ হাতা শার্ট আর প্যান্ট।
মল্লিক মশাইদের বাড়ির পুজোতে খুব হৈচৈ হয়। বদ্রু দেখলো তারই মত বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাত পেতে প্রসাদ নিচ্ছে।
খিদে একটু পাচ্ছিলো বটে তাই অজান্তেই বদ্র মল্লিকদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গিয়েছিলো।
কিন্তু তারপর হটাৎ কি মনে হতে বদ্রু দাঁড়িয়ে গেলো রাত্তার মাঝেই। একবার আকাশের দিকে তাকালো আর তারপরেই কেন সে জানে, কিন্ত মনের ভেতর দুম করে একটা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো। আর তার ফলে বদ্রু উল্টো দিকে ঘুরে বাড়ির দিকে যেতে শুরু করলো।
রাতে মাকে বলে একটা নতুন জামা বের করে রেখেছিলো বদ্র। মা একটু অবাক হলেও কিছু বলেনি, শুধু বলেছিলো আজ তাড়াতাড়ি ফিরবে।
বদ্র একবার জামাটা গায়ে চাপিয়ে ভেবেছিলো মহাসপ্তমীর দিন বাইরে বেরোবে।
নতুন জামা কাপড়ের ওপর তার ঝোঁক খুব বেশি নেই, কিন্তু এই জামাটার রং কালো - আর নকশাটাও বদ্রুর খুব পছন্দের।
সন্তার জামা হলেও বুকে একটা মহিষ এর মতো প্রাণী আঁকা আছে, যেটার জন্যে জামাটা বদ্রুর আরো ভালো লাগে।
দরজাটা খুলে বাইরে বেরোতেই বদ্রুর চোখ পড়লো দুটো বাচ্চা ছেলের দিকে।
ছেলে দুটো নিঃসন্দেহে খুব গরিব পরিবারের - গায়ের রং কুচকুচে কালো, খালি গায়ে দুজনে কাঠি দিয়ে দুটো টায়ার ঘোরাতে ঘোরাতে যাচ্ছে।
কাজটা যে তারা খুবই খুশি মনে করছে সেটা বদ্রু বুঝতে পারলো আর সেটা মনে হতেই প্রায় অজান্তেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লো।

চালকলে এই তিন দিন ছুটি থাকে বলে অষ্টমী থেকে দশমী অব্দি বাবা বাড়িতেই থাকে।
মাও যে বাড়িগুলো তে কাজ করে তারা ছুটি দিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সবাই বাড়িতে থাকলেও বদ্রু জানে যে তারা বাইরে খুব একটা যাবে না, বাড়ির ভেতরেই থাকবে।
রান্না তো ভালো কিছু হবেই না, বরং এক বেলা করে উপোষ থাকবে দশমী অব্দি।
ছোট বেলা থেকেই এই ব্যবস্থা দেখে আসছে বলে বদ্রুর এখন আর খারাপ লাগে না।
যে বেলাটা উপোষ থাকে তারা সেই বেলায় বদ্রুর একটু খিদে পেয়ে যায়।
কিন্তু ব্রু খিদে চেপে রাখতে শিখে গেছে আতন্তে আস্তে।
বরঞ্চ একটা কথা মনে হতে তার মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

গতবছর শুনেছিলো অতনুর কাছে ঘটনাটা।
অতনুদের বাড়িতে পুজোতে বেড়াতে এসেছিলো দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয়, তাদের অতনুর বয়সী একটা ছেলে আছে।
সারাদিন ধরে একটা দম দেওয়া এরোপ্লেন অতনুকে কিনে দেবে বলেছিলো ওরা।
কিন্তু রাতে ঠাকুর দেখে ফিরে বললো আনতে ভুলে গেছে, কিন্তু পরে অতনু দেখেছিলো ওদের ছেলের জন্যে ওরা একটা নতুন এরোপ্লেন ব্যাগে তোকাচ্ছে।
অতনুর খুব কষ্ট হয়েছিল - কিন্তু কথাটা ওর মা বাবা কে বলেনি। স্কুল খুলতে বদ্রু কে বলেছিলো।

নবমীর সন্ধে বেলায় তখন পুরো পাড়াটা মন্ত্রচারণ এর শব্দে আর যজ্ঞের ধোঁয়ায় ভোরে গেছে।
সব জায়গায় ভিড় - প্যান্ডেল এ প্যান্ডেল এ যেন মাকে আরতি করার প্রতিযোগিতা চলছে।
শুধু বদ্রদের বাড়িতে মোমবাতি জ্বলছে আর বাবা মা তার দু পাশে বসে কথা বলছে।
বদ্রু শুনলো বাবা মাকে বলছে - অনেকে মিলে একজনকে ঘিরে ধরে তার ওপর অত্যাচার করা অন্যায়।
বাবার অনেক কথা বুঝতে না পারলেও এ কথাটা যেন বদ্রু কিছুটা বুঝতে পারলো। সে জানে কেমন লাগে - আগের ক্লাসের পরীক্ষায় নারান একটা উত্তর জানতে চেয়েছিলো। কিন্তু বদ্রু জানলেও বলেনি কারণ সেটা অন্যায় হতো। সেজন্যে পরীক্ষার পরে স্কুল এর পাশের পুকুরের ধারে নারান আর তার তিন চারজন সাঙ্গপাঙ্গ মিলে বদ্রুকে খুব মেরেছিলো।
বদ্রু গরিব ঘরের ছেলে, মার্‌ খাওয়া তার কাছে বড় ব্যাপার নয়, অতটা লাগেওনি - কিন্ত ওই সবাই মিলে ঘিরে ধরে মারলে কিরকম একটা অপমান হয়....

রাতে বিছানায় শুয়ে বদ্র অনুভব করলো যে পুজোর দিন গুলোতে তার আনন্দের থেকে দুঃখই বেশি হচ্ছে।
প্রতিবারের মতো এবারেও দশমীতে গভীর রাত অব্দি বিসর্জন চলছে।
মফত্ল এর ছোট বড়ো মাঝারি রাত্তা থেকে গঙ্গার ঘাট অব্দি লোক থিকথিক করছে।
নাচ গান হচ্ছে প্রচুর - কিন্তু সবার মুখেই একটা বিষন্নতার ছায়া।
আবার এক বছর - আবার এস মা - আবার এক বছরের অপেক্ষা।
উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার একটা মন খারাপের রেশ যেন ঢাকের শব্দের মতো সবদিক ঢেকে রেখেছে।

ভোর হওয়ার আগেই বদ্র উঠে গেছে ঘুম থেকে - মা বাবা উঠেছে অনেক আগেই।
রাত পোহালেই একাদশী - পুজো শেষ!
কিন্তু ব্র জানে তাদের পুজো এই শুরু!
ভোরের আলো ফুটলেই মা বাবা আর বদ্রু কনক দুর্গা মন্দিরের পাশের রাত্তা দিয়ে চলে যাবে অনেক দুরে।
হাটতে হবে অনেকটা - তারপর আসবে জঙ্গলের ভেতর বটগাছের নিচে মন্দির।
মহিষাসুর এর মন্দির - তাদের দেবতা।
জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনে আসছে তারা মহিষাসুরের বংশধর।
তাদের মতে অন্যায় ভাবে যুদ্ধে দুর্গা মহিষাসুর কে হারিয়েছিল - তাই তাদের কাছে দুর্গা পুজো শোকের উৎসব।
দুর্গাপুজো শেষ হয়ে গেলে ওদের উৎসব শুরু হয় - এই মন্দিরেই পুজো আরম্ভ করে।
কিন্তু বাবা এটাও বলে দিয়েছিলো যে এসব কথা বাইরের কাউকে না বলতে। তাই বদ্রর পদবি কেন 'অসুর' সে কথা বদ্রু কাউকে বলেনি।

উৎসব শুরু হলে যেমন মনটা আনন্দে ফুরফুর করে ওঠে, বদ্রুর সকাল থেকে সেরকমই মনে হচ্ছে।
সে জানে পয়সা জমিয়ে তার জন্যে ভালো জামা কাপড় মা কিনে রেখেছে।
বাবা মেলা থেকে আগেই নিয়ে এসেছে একটা নতুন খেলনা।
ভালো খাওয়া দাওয়াও হবে তাদের বাড়িতে - সাধ্যমত।
কিন্তু এই ভালোলাগার মধ্যেও মাঝে মাঝে বদ্রুর অতনুর শুকনো মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
অতনু পুজো বলতে পাগল - তাই পুজোটা শেষ হয়ে গেলে ওর কতটা মন খারাপ হয় বদ্রু জানে।
একদিন ঠিক ওদের বাড়ির উৎসব এ অতনুকে নিয়ে আসবে - এই কথা ভাবতে ভাবতে বদ্রু মা বাবার সঙ্গে হাঁটছিলো।

শরতের রাতের আকাশ আলো করে আছে প্রায় গোলাকৃতি চাঁদ।
আর কয়েকদিন বাদেই কোজাগরী পূর্ণিমা।
বড়ো উৎসবের কয়েকদিন পরেই আবার একটা ছোট উৎসব।
দুরে দেখা যাচ্ছে গঙ্গার বুক দিয়ে একটা কাঠামো থেকে দুর্গা আর মহিষাসুরের মূর্তি ভেঙে গিয়ে শুধু মাথা দুটো ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলেছে।
যেন দুটো মুখ দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে।
যেন দুজনেই বলছে - এইসব মানুষগুলো ভাবে আমাদের বিশ্বাস-ই সব। এরা জানে না যে আসল কথাটা হলো বেঁচে থাকার আনন্দ - নিজের আনন্দ, সবার আনন্দ।
এইজন্যেই তো দেবতা আর রাক্ষস সেজে কয়েকদিনের জন্যে এদের কাছে আসা - যাতে এরা নিজেরাই নিজেদের ভেতরের মানুষটাকে চিনতে পারে।

কিন্তু বেশি দূর যাওয়ার আগেই - একটা তীব্র হাওয়ার দাপটে দুটো নিষ্প্রাণ মুন্ডু গঙ্গার বুকে ডুবে গেলো।