হেলসিংকি থেকে অনেকদিন পর ফোন এলো, দুর্গাপুজোর পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে কমিটির প্রাক্তন সদস্য হিসেবে কিছু লিখতে বা বলতে হবে। শোনার পরে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লাম, ভীড় করে এলো কত শত সুন্দর স্মৃতি। শুনলাম পুজো এখন অনেক বড় আকার ধারণ করেছে কারণ সদস্য সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
হেলসিংকির দুর্গাপুজো হলো আমার জীবনের এখনও পর্যন্ত সবথেকে আনন্দের দুর্গাপুজো, অবশ্যই ছোটবেলার দুর্গাপুজো গুলোকে বাদ দিয়ে। এর কারণ হলো পুজোতে সরাসরিভাবে যুক্ত থাকা, একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সবাই মিলে দায়িত্ত্ব ভাগ করে পুজো করার আলাদা একটা মজা ছিল।
বিয়ের পরেই ২০০৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরাইল থেকে ফিনল্যান্ডে পৌঁছেছিলাম আমার হাসব্যান্ড ড: সৌরভ রায় এর কর্মসূত্রে। তখন হিমেল হাওয়ায় সব গাছের পাতা ঝরে গেছে, দুর্গাপুজোও সবে শেষ হয়েছে, আবার একটি বছরের অপেক্ষা। তবে Indian embassy থেকে দিওয়ালির অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়ে সেখানে গিয়ে দেখলাম দুর্গাপুজোর রেশ তখনও কাটেনি। অনেক ভারতীয় এবং বিশেষ করে বাঙালি দের সাথে আলাপও হয়ে গেলো। এরপর সারা বছর নানান অনুষ্ঠান পালন হতে হতে বহু প্রতীক্ষিত দুর্গাপুজো এসে গেলো। সেই সময় একই প্রতিমা প্রত্যেক বছর পুজো করা হতো। খুব ছোট হলেও সুন্দর ছিল মা দুর্গার সেই প্রতিমাটি। পূজার্চনার দায়িত্বে থাকতেন দুর্গাপুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা আমাদের সবার প্রিয় শান্তিদা। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে সবাই মিলে পুজোর বাজার করা, রান্না করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর জন্য রিহার্সাল করা, পুজোর দিন পারফর্ম করা এসবের মধ্যে দিয়ে হইহই করে কাটত কটা দিন।
২০০৫ এ আমি যখন হেলসিংকি দুর্গাপুজো কমিটির কালচারাল সেক্রেটারি তখন এক সমস্যা তৈরি হয়েছিল মাইক এর ব্যবস্থা করা নিয়ে। কেউ কোনো সমাধান করে উঠতে পারেনি। অবশেষে আমার এক ফিনিশ বন্ধু তার ব্রিটিশ husband কে রিকোয়েস্ট করে তাদের ব্যান্ডের থেকে সব ব্যবস্থা করে দেয় এবং মার্টিন নিজে গাড়ি চালিয়ে সব কিছু এনে দেয় যা কোনদিন ভুলব না। আমার কাছে কলকাতার কুমোরটুলি থেকে অনেক মেইল আসতো, বিভিন্ন নামী অনামী শিল্পীরাও মেইল করতেন, আমাদের পুজোতে অনুষ্ঠান করবেন বলে। এরকমই একদিন বিখ্যাত গায়ক ড: অনুপ ঘোষাল এর মেইল পাই। উনি লিখেছিলেন ‘আমি আমেরিকা, ইংল্যান্ড আরও অনেক দেশে অনুষ্ঠান করেছি কিন্তু ফিনল্যান্ডে আমার কখনও যাওয়া হয়নি। আমি আপনাদের গান শুনিয়ে নির্মল আনন্দ দিতে চাই।’ খুবই দুঃখের সাথে আমার ওনাকে না বলতে হয়েছিল কারণ সেই সময় আমাদের সেই আর্থিক সামর্থ ছিল না।
লিখতে লিখতেই কতজনের মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো যাদের সাথে এখন আর সরাসরি যোগাযোগ নেই, কেউ কেউ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। অথচ সেই সব দিনগুলো সবাই মিলে কি আনন্দেই না কাটত। মনে হচ্ছিল যদি পুজোর সময় চলে যেতে পারতাম হেলসিংকি! যদিও জানি তা সম্ভব নয়! তবু তো এই লেখার মধ্যে দিয়েই পুরনো নতুন সবার সাথেই একবার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারলাম। হেলসিংকি দুর্গাপুজোর দীর্ঘ আয়ু কামনা করি, কলেবর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাক। সবার পুজো খুব ভাল কাটুক। শারদীয়া শুভেচ্ছা রইলো সবার জন্য।