আমাদের এবারের দুর্গাপূজা ফিনল্যান্ডের ২৫তম বার্ষিকীতে পা দিলো। বাঙালির দুর্গাপুজো মানেই বাঙালিয়ানার পরিচয়, তা সে স্বদেশে বা বিদেশেই হোক না কেন। বাঙালিয়ানার পরিচয় স্থান-কাল-পাত্র বিশেষ নয়। সেটা আমাদের মজ্জাগত। বাঙালি মানে কি শুধু মাছ আর মিষ্টি? অবশ্যই বাঙালির পেটুক বলে বদনাম আছে, কিন্তু বাঙালিয়ানার পরিচয় তো আমাদের চিন্তা, ভাবনা, চাল, চলনে। আমাদের কলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর কৃষ্টির মাধ্যমে সেই চিত্রটাকে প্রস্ফুটিত করার চেষ্টায় আমরা আজ মগ্ন, আমাদের দুর্গাপুজো উপলক্ষে।
“আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান” এর সব থেকে বড় পরিচয় বোধহয় বাঙালি। রাজনীতি থেকে খেলা, সব ব্যাপারেই সবার একটা ব্যক্তিগত মতামত আছে, এবং সেটাকে তর্কের মাধ্যমে উপস্থাপনা করার জন্য কলেজ ক্যান্টিন থেকে অফিসের টেবিল চাপড়াতেও বাঙালি পিছপা হয়না। আর যদি সেটা হয় বন্ধুদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক, তাহলে তো কব্জির লড়াইয়ে গিয়েও কখনো শেষ হয়। কিন্তু পরদিন আবার সব ভুলে গিয়ে মিলে মিশে নতুন বিষয়ে তর্ক অথবা ক্যারম-এর স্ট্রাইকার এ টোকা - এই তো আমাদের পরিচয়। আমরা ওপিনিওনেটেড, কিন্তু ওপিনিওনের লড়াইটাকে ব্যক্তিগত লড়াই এ পরিণত না করাটাই আমাদের বাঙালিয়ানার পরিচয়।
গত এক বছরে বেঙ্গলি এসোসিয়েশন অফ ফিনল্যান্ডের সদস্যসংখ্যা অনেক বেড়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ফিনল্যাণ্ড এ বসবাসকারী অনেক বাঙালিরাই আমাদের এসোসিয়েশনের থেকে এখনো দূরে। হয়তো বা আমরা তাদের কাছে আমাদের কথা নিয়ে হাজির হতে পারিনি। হয়তো বা দূর থেকে বোঝার চেষ্টা - আমরা আর্গুমেন্টেটিভ আর ওপিনিওনেটেড হওয়ার সাথে সাথে সার্থক বাঙালিয়ানার পরিচয় রেখে ওপেন মাইন্ডেড তো? আমরা সোশ্যাল মিডিয়া তে ঝড় বইয়ে ঝগড়া করেও আবার একসাথে ওল্ড মঙ্ক এ চুমুক মারতে পারিকি? আমরা পুরোনোতে ভুলে থাকি নাকি নতুনকে বরণ করতে জানি? আমরা কি জ্ঞানের পূজারী নাকি কর্পোরেট কেরানী? আমরা মন খুলে হাসতে পারি নাকি গুজগুজ-ফিসফিসে ব্যস্ত থাকি? উত্তর খোঁজার দায়িত্বটা আমাদেরই।
জয়েন্ট-ফ্যামিলি থেকে মাইক্রো-ফ্যামিলি তে পরিণত হওয়া বাঙালি প্রবাসে এসে একটা আড্ডা আর পরিবার খুঁজে পাক, এই আশা নিয়েই আমরা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে পথচলা শুরু করেছিলাম। অনেক সাফল্যের মধ্যেও অনেক মর্মান্তিক ঘটনার আমরা সাক্ষী। গত বছর শুভম দাশগুপ্তর সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ভাবিয়েছে নতুনদের জড়িয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা বাড়ানো কতটা প্রয়োজন, ফিনল্যান্ডের জীবন সম্পর্কে নতুনদের ওয়াকিবহাল করার দায়িত্ব নেয়ার প্রয়োজন।
পুজোর হাত ধরে ধরে সৃজন ও পেরিয়ে এলো অনেকগুলো বছর। এবারের সৃজন এক অনবদ্য প্রচেষ্টার প্রতীক - রজত জয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে এক অনন্য স্মৃতি। সবাইকে উৎসাহিত করা বিভিন্ন বিষয়ে অবদান জোগাড় করা - যেমন ফিন-টিন্স, পয়েন্ট-অফ-ভিউ, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা, বা কাপল-গোলস - পুরো আয়োজনের পুরোধা পূবালী চক্রবর্তী। পাঠকের সংখ্যা বাড়ানোর প্রচেষ্টায় আমরা মাথায় রেখেছি রিডার্স-এক্সপেরিয়েন্স। তাই, পিডিএফ থেকে শুরু করে ওয়েব, আর নতুন ফর্মে কি করে আমাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ করা সম্ভব তাই নিয়ে মেতে আছে - পলাশ ব্যানার্জী, শ্রীপর্ণা দাশ। রাশি রাশি সৃজনীর এই সম্ভার এবারে প্রকাশ করার প্রাথমিক ভূমিকা এই তিন জনের। আশা করি পড়ে সবার ভালো লাগবে। আর্থিক সামর্থ থাকলে আমরা হয়তো চেষ্টা করতে পারতাম একটা বই আকারে প্রকাশ করার, সেই প্রচেষ্ট ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকলো। আপাতত মোবাইলে, কম্পিউটারে আর প্রিন্ট নিয়ে পড়ে ফেলতে হবে সৃজনের এই রজত জয়ন্তী বার্ষিকী।
এবছরের সৃজনের অনুপ্রেরণায় জন্ম নিক - সারা বছরের সৃজনশীলতার অঙ্গীকার, সেটাই হবে বাঙালিয়ানার সার্থক স্বাক্ষর।
২২.১০.২০২৩