ছাতুটা সবে পেয়াঁজ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাখছিলো লক্ষ্মণ, ঠিক তখনি আওয়াজটা কানে এল। চাপা একটা শোরগোল বেশ অনেক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছিলো সে। কিন্তু গা করেনি। গা করলে চলবেও না তার। সকাল থেকে মোটে দুটো আপ ডাউন ট্রিপ মারতে পেরেছ। প্যাসেঞ্জারগুলোও এখন হেব্বি সেয়ানা। রিক্সা হেঁকেও ফাঁকা অটো দেখলে টুক করে উঠে পড়ে। ভাদ্র মাসের এই পচা গরমে একটা ট্রিপ মারলেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায় । ঘামে জবজবে হাফ শার্টটা এবার গা থেকে খুললো লক্ষ্মণ। ঘাম বসে বসেই বুকে এতো কফ জমেছে তার। রিক্সা টানতে হাঁফ ধরে যায় অল্পতেই। খক খক করে কাশলে প্যাসেঞ্জার পায় না বেশী। মুদির দোকানের জীবনদা বলে - " মাকস পর লক্ষ্মণ, কাশি তে বড় জীবাণু ছড়ায়। " আচ্ছা মাকস পরে কি আর রিক্সা টানা যায়? তাছাড়া করোনাও তো এখন হচ্ছে না আর। ছাতুটা শেষ করে একটা বিড়ি ধরাবে ভাবছিলো, তখনি কালুদা হন্তদন্ত হয়ে এলো তার দিকে।

- খবরটা শুনেছিস তো লক্ষ্মণ ?
- কি খবর গো কালুদা ?
- ওই গলির মোড়ে রে , ভাঙা ম্যানহোলে একটা কুকুর পড়ে গেছে। 
- কুকুর পড়ে গেছে ? এই বলতে তুমি এদ্দুর এলে কালুদা ?
- আরে না রে , এ যে সে কুকুর নয়।  এ বিদিশি কুকুর। 
-  বিদিশি ?
- দ্যাখ গে যা, কতো লোকের ভিড় হয়েছে। মোড়ের মাথার ওই বড় বড় ফ্লাট বাড়ি গুলোরে , ওর মধ্যেই কোনো একটা বাড়িতে থাকে। 
- তা পড়লো কি করে ?
- আমি কি করে বলবো ? আমি কি পড়তে দেখেছি নাকি ? চল না লক্ষ্মণ , গিয়ে একটু ফিরিতে রগড় দেখে আসি। 
- না গো কালুদা। আমি এখন প্যাসেঞ্জার তুলব। সকাল থেকে মোটে দুটো টিরিপ মেরেছি। প্যাসেঞ্জার পাচ্ছি না। মটকা গরম হয়ে আছে। 
- আরে চল -ই না। প্যাসেঞ্জার পাবি কোত্থেকে? সবাই তো দাঁড়িয়ে রগড় দেখছে। এতক্ষনে বোধয় টিভির লোক চলে এসেছে।
- টিভি ? একটা কুত্তার বাচ্চা পড়ে গেছে তার জন্য টিভি থেকে লোক এসেছে ? কি বলো গো কালুদা ! চলো তো দেখি। 

কালুর সাথে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে লক্ষ্মণ। কালু তাকে সাবধান করতে থাকে।

  • শোন, ওইখানে গিয়ে আবার কুত্তার বাচ্চা টাচ্চা বলিস না। অনেক দামী কুকুর।

ভিড়ের কাছে গিয়ে লক্ষ্মণরা সত্যি তাজ্যব। বহু মানুষ এসেছে। টিভির থেকে সত্যি সত্যি লোক এসেছ। ক্যামেরা ঘোরাচ্ছে এদিক ওদিক। শুধু টিভি নয় , বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী পশুপ্রেমী সংস্থা , সারমেয় প্রেমী সংগঠনও এসেছ। মোবাইলে ছবি উঠছে টকাটক। অনেকেই ক্যামেরার সামনে বাইট দিচ্ছে। দু’চার জন উঠতি নায়িকাদেরও দেখতে পেলো লক্ষ্মণরা। সবাই কথা বলতে ব্যস্ত। কয়েকজনের চোখে জল। কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা বুজে আসছে। এতকিছুর মধ্যে কুকুর ছানাটাকে কোথাও দেখতে পেলো না লক্ষ্মণ। ভিড় ঠেলে ভিতরে ঢোকা মুশকিল। খানিকটা বাধ্য হয়েই একটা উঁচু পাঁচিলের উপর উঠলো লক্ষ্মণ আর কালু। এবারে দেখা যাচ্ছে। ভাঙা ম্যানহোলের মধ্যে কি ভাবে যেন পড়ে গেছে কুকুর ছানাটা। শুধু মাথা টুকু আর একটা হাত বাইরে বেরিয়ে আছে। ম্যানহোলটার একদম হাড় জিরজিরে অবস্থা। একটা রড খুব বিপজ্জনক ভাবে উঁচু হয়ে আছে কুকুরটার ঘাড়ের কাছে। কুঁই কুঁই করছে কুকুর ছানাটা। লক্ষ্মণের দেখে বড় মায়া হলো । তার দু’মাসের ছেলেটাও জীর্ণ গলায় ওই রকম কুই কুঁই করতো। বাঁচাতে পারেনি তাকে।

- কালুদা , এতো লোক , কেউ এগিয়ে গিয়ে বাঁচায় না কেন কুকুরটা কে ?
- সবাই তো টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্তরে। তাছাড়া ওই পাঁকের মধ্যে কে নামবে ?
গুমোট গরম , তার সাথে চড়া রোদের তাপ। কিছু পশুপ্রেমী মানুষ কুকুরটার কাছে এগিয়ে গেছে।  বোতল থেকে জল দিচ্ছে। বেচারা কুকুর জল খাবে কি , ঘাড়ের কাছে বড় রড আটকে আছে। 
- আমি একবার চেষ্টা করবো কালুদা ? কি বলো ? যদি বাঁচাতে পারি ?
- তুই দেখবি ? দ্যাখ। টিভি থেকে লোকেরা এসেছে।  বাঁচাতে পারলে তুই হিরো হয়ে যাবি। 

ভুল বলেনি কালু। লক্ষ্মণও মনে মনে একই কথা ভাবছিলো। সে যদি কুকুরটাকে বাঁচায় তাকে নিশ্চই টিভিতে দেখাবে। তার বৌ কল্পনা একবার হলেও ঠিক বুঝতে পারবে যে লক্ষ্মণ হাল ছেড়ে দেয়নি। সেইদিন ওই কোলের শিশুটাকে বাঁচাতে পারেনি , যাই হোক একটা নিরীহ প্রাণ তো বাঁচাতে পারবে আজ । লক্ষ্মণকে পারতেই হবে। টিভির পর্দায় মুখ দেখাতেই হবে। জিদ চেপে গেলো। ভিড় ঠেলে লক্ষ্মণ একজন হোমড়া চোমড়া গোছের লোকের দিকে এগিয়ে গেলো

- আমি যদি কুকুরটাকে তুলে দেই, আমায় ওই টিভিতে দেখাবে বাবু ?
- আগে তো বাঁচাও , টিভিতে ঠিক দেখাবে। টিভি থেকে কতো লোক এসেছে দেখেছো ? বাঁচাতে পারবে কি ?
- আমি পারবো বাবু।  কিন্তু আমায় যেন টিভিতে দেখানো হয়। হবে তো বাবু ?

চুক্তি হলো লক্ষ্মণ যদি কুকুরটাকে বাঁচাতে পারে তাহলে তার নাম দিয়ে টিভিতে নিউজ হবে। টিভি থেকে আসা ধোপদুরস্ত বড়ো বাবুরা, দাড়িওয়ালা ক্যামেরাম্যানরা সবাই আশ্বাস দিলো। এ তো আজকের ব্রেকিং নিউজ। “আর দেরি কোরো না , বাঁচাও কুকুরটা কে।” - ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে উঠলো। কালুর আনা এক শিশি কেরোসিন ভালো করে গায়ে মেখে ম্যানহোলের দিকে এগোলো লক্ষ্মণ। বড় ঝুঁকির কাজ। কুকুরটা এতক্ষনে একদম নেতিয়ে পড়েছে। মরে গেলো নাকি ? আসতে আসতে কুকুরটার মাথায় হাত বোলালো সে। কাতর চোখে কুকুরটা তাকালো তার দিকে। যেন বলছে - “বাবা, আজ আমাকে বাঁচাও।”

আর দেরি না করে আধলা ইট দিয়ে ভেঙে ফেললো ম্যানহোলের অন্য পাশটা। তারপর জয় মা বলে নেমে পড়লো। অন্ধকার, নিকষ কালো, দুর্গন্ধ, ময়লা ভর্তি ড্রেন। পা ঢোকাতেই টের পেলো পা টা কেটে গেছে ধারালো কিছুতে। রক্তের লাল রং ঢেকে গেলো নোংরা কালো জলে। ম্যানহোলের রড গুলো কোমরে সাঁড়াশির মতো চেপে বসছে। মাথা ঝিম ঝিম করে উঠলো। অনেক্ষণ চেষ্টার পর লক্ষ্মণ উঠে এল। এক হাতে কুকুর ছানাটি। কুকুরটার গায়েও পাঁক লেগে আছে। আসতে করে নামিয়ে রাখলো কুকুরটা কে। সবার কৌতূহলী চোখ, শেষ রক্ষা হলো তো ? কুকুরটা একদম নড়ছে না । ছুটে এলো মনিব পরিবার। এতক্ষন তারা যেন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। প্রভুর ঘ্রাণ পেয়ে একবার চোখ খুললো কুকুরটা। চারিদিকে আবার গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। যুদ্ধ কালীন তৎপরতায় দু’দিক থেকে দুটো বিশাল গাড়ি এসে দাঁড়ালো, কুকুরটাকে নিয়ে যাওয়া হবে পশু হাসপাতালে । চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তুলতে হবে আহত প্রাণীটাকে । স্বেচ্ছাসেবী পশুপ্রেমী সংগঠন থেকে যাঁরা যাঁরা এসেছিলেন, একে একে তাঁরাও উঠে পড়লেন গাড়িতে। গন্তব্য হাসপাতাল।

টিভিতে সন্ধ্যেবেলার খবর , অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ঘটনা। সরকারের অনুপ্রেরণায় , পশুপ্রেমী সেচ্ছাসেবকদের নিরলস চেষ্টায় ও এলাকাবাসীদের সাহায্যে আজ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পেয়েছে এক সারমেয় সবাক। সন্ধ্যে বেলায় লাইনে এসে দাঁড়ায় লক্ষ্মণ। আজ দু চারটে টিরিপ বেশি মারতে হবে। সারাদিন কোনো রোজগার হয়নি।