ভাদ্র মাসের চরিত্র বড়ই বিচিত্র। এক মুহূর্তে কাঠ ফাটা রোদ আর পর মুহূর্তে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। তার উপর যতই বৃষ্টি হোক বা ঝড়, সারাক্ষণ একটা ভ্যাপসা ভাব যেন অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। কাছে ছাতা থাকলেও এই দমকা ঝড়-বৃষ্টিতে শুধু মাত্র মাথাটা বাঁচানোই খুব কষ্টসাধ্য হয়ে যায়, বাকি শরীরের কথা না বলাই ভালো। তাই সাধারন অবস্থায় এমন ঝড়-জল মাথায় নিয়ে কারোর বাড়ি যাওয়ার কথা এলেই বাইরের গরম যেন হঠাৎ করেই মাথায় চেপে বসে। গাদাগাদি করে ভিড় বাসে ওঠা, ঘাম আর বৃষ্টি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া সবকিছুই বড় বিরক্তিকর। তবে এখনের পরিস্থিতি এর থেকেও ভয়ানক। লকডাউনের দিনগুলো ছাড়া বাকি দিনগুলোতে মানুষের ভিড় দেখলে বোঝাই যায় না যে একটা পেন্ডামিক পরিস্থিতি চলছে। নিয়ম- নিষেধাজ্ঞার কাঁথায় আগুন ধরিয়ে সবাই যেন পরস্পরের গলা জড়িয়ে গাইছে ’আমরা করব জয় নিশ্চয়।’
বাবার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জয়ন্তকে একবার মামার বাড়ি যেতেই হবে। জন্মের আগেই সে বাবাকে হারায় এক দুর্ঘটনায়। অনেকে বলে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে, কিন্তু আসলে কিভাবে তা সে নিজেও জানে না। তাই জন্মের পর প্রথম দশ বছর সে মামার বাড়িতেই বড় হয়। তারপর নিজের বাড়ি ফিরে আসে। তাই প্রতি বছর সে নিজে গিয়ে মামার বাড়ির সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসে। কিন্তু এবছর পেন্ডামিকের জন্য ভেবেছিল ফোনেই কাজটা সেরে ফেলবে। কিন্তু তার মা তাতে একেবারেই খুশি নয়। অন্য বছর হলে হয়তো তার মা রাজি হয়ে যেত কিন্তু পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে তা একেবারেই মানবেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাকে মামার বাড়ি যেতেই হবে। অনেক ভেবে সে ঠিক করল শুক্রবার লকডাউনের দিন বিকালের দিকে হেঁটে রওনা দেবে, শনিবার মামার বাড়িতে কাটিয়ে রবিবার গাড়িতে ফিরে আসবে। প্রথমে জয়ন্তের মা হেঁটে যেতে বারণ করেন কিন্তু জয়ন্ত বুঝিয়ে বলে যে-” শুক্র শনি পরপর দু-দিন লকডাউন। বিকালের দিকে পুলিশের টহলদারিও তেমন একটা থাকবে না। তাই শুক্রবার বিকালে হেঁটে যাওয়াই ভালো। আর রবিবার ছুটির দিন। সন্ধ্যার দিকে লোকজন কম তাই গাড়ি করে ফিরে পড়ব।” জয়ন্তের কথা শুনে তার মা আর কিছু বলে না। শুক্রবার বিকাল তিনটে নাগাদ সে বেড়িয়ে পড়ে। দামোদর নদীর ধার ধরে রাজবলহাট থেকে কালিকাপুর হেঁটে যেতে প্রায় সোয়া চার ঘণ্টা লাগবে। একটু জোরে পা চালালে সন্ধ্যার আগেই সে মামার বাড়ি ঢুকে যাবে। সেই ভেবেই জয়ন্ত পিঠে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
এমনিতে দামোদর নদীর পাশে জনবসতি প্রচুর। কিন্তু মাথার উপর জ্বলন্ত সূর্য আর সামনে জন-মানবহীন রাস্তা দেখে একটু থমকে গেল জয়ন্ত। সামনে পিছনে যতদূর নজর যায় দু-একটা কাক পক্ষী ছাড়া অন্য কোনো প্রাণের চিহ্ন সে দেখতে পেল না। একবার নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিল। তিনটে নয়। আশা করছে সাতটার মধ্যে সে পৌঁছে যাবে। কানে এয়ারফোন লাগিয়ে গান চালিয়ে সে রাস্তা ধরল। অনেকটা প্রায় গানের তালে তালে পা-ফেলে বেশ একটা নাচার ভঙ্গীতেই বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছে। প্রায় ছয় মাস পর সে এই দিকটায় আসছে ঠিকই, তবে এই ছ’মাসে আশেপাশের পরিবর্তন খুবই যৎসামান্য। তাই জয়ন্ত সেদিকে বিশেষ কোনো লক্ষ্য দিল না। নিজের মনে গান গাইতে গাইতে কতটা পথ এগিয়ে এসেছে তা সে বুঝল না। হঠাৎ রাস্তার ধারে শিব মন্দিরের চূড়া দেখে সে থমকে গেল।
- আরে, এটা জলেশ্বর শিব মন্দিরের পুরানো চূড়াটা না? কিন্তু নতুন গেট আর সাদা চূড়াটা গেল কোথায়? এই মন্দিরে কত বার এসেছি কিন্তু আগের স্মৃতির সাথে যে কিছুই মিলছে না। এই মন্দির যেন অনেক বছর আগের মন্দির।
নিজের মনের মাঝে চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের ঝড় তার স্মৃতি গুলোকে শূন্যে তুলে মাটিতে আছড়ে ফেলছে। সূর্যের তেজটাও যেন হঠাৎ করে খুব বেড়ে গেল। অতিরিক্ত আলোয় সবকিছু কেমন ধোঁয়াশা মনে হল তার।
বেশীক্ষণ না দাঁড়িয়ে সে আবার পথ চলতে শুরু করল। কিছুটা যেতে না যেতেই সে সূর্যের তাপে বেশ হাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে খেতে খেতে তার মায়ের কথা মনে পড়ল- একরকম জোর করেই মা তার ব্যাগে জলের বোতল দিয়ে দেয়। কিন্তু এই ছোটো জলের বোতলই বা কতক্ষণ তার তেষ্টা মেটাবে? অল্প একটু পথ যেতে না যেতেই আবার তার জলের দরকার পড়ল। বার চারেক জল খেতেই বোতল শূন্য। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে খালি বোতলটা ব্যাগে রেখে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল একেবারেই জনবসতি শূন্য ধু-ধু প্রান্তরের মাঝখান দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। এই রাস্তার শুরু আর শেষ কোথায় তার কোনো হদিস নেই। যেন আকাশের এক প্রান্ত থেকে রাস্তা নেমে এসে অন্য প্রান্তে মিশেছে। ফেলে আসা পথের দিকে তাকিয়ে সে একটা কুঁড়ে-ঘরেরও হদিস পেল না। খুব অবাক লাগলো তার। এই ছয়মাসে তবে কি এতো পরিবর্তন হয়ে গেছে?
কোথা থেকে একরাশ মেঘ এসে সূর্যকে ঢেকে দিল। একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জয়ন্ত। রাস্তা ধরে একটু জোরে পা-চালিয়ে এগিয়ে গেলে। ভেবেছিল বৃষ্টি হবে। বেরোনোর সময় সে মনে করে ছাতা ব্যাগে রেখেছিল। ছাতা নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে তার ভালোই লাগে। জুতো-জামা একটু ভিজবে ঠিকই কিন্তু এমন রোদের থেকে তা শতগুনে ভালো। কিন্তু সেই আশাতে জল ঢেলে দিয়ে কালো মেঘ উড়ে একেবারে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। তপ্ত জ্বলন্ত রাস্তার দিকে ভালো ভাবে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ ঝলসে যাওয়া আলো। বাঁ-হাত কপালের কাছে রেখে কোনো রকমে চোখ আড়াল করে হেঁটে চলেছে জয়ন্ত।
- না, ছাতা বের করতেই হবে। বৃষ্টি না হলেও এই রোদ থেকে আপাতাত বাঁচতে গেলে ছাতা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথার উপর মেলে ধরল। মোবাইলের গান আর ভালো লাগছে না তার। এয়ারফোন কান থেকে খুলে পকেটে রেখে আবার হাঁটতে থাকল। কিন্তু কয়েক পা এগিয়ে যেতে না যেতেই জয়ন্ত লক্ষ্য করল তার কোনো ছায়া পড়ছে না। থমকে দাঁড়িয়ে নিজের চারিদিকেই একবার পাক খেলো।
- না, কোনো দিকেই যে ছায়া পড়ছে না। তবে কি সূর্য একেবারে মাথার উপর? কিন্তু এই এতো বড় ছাতার অন্তত ছায়া পড়া উচিত। সেটাও উবে গেল কি করে?
নিজের মাথা থেকে ছাতা সরিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়েই এক ঝটকায় চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে নিল।
- উফ্! কি রোদ রে বাবা! এমন রোদে জ্যান্ত মানুষও শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই সে দেখতে পেল একটা লম্বা ছায়া পিছন দিক থেকে তার দিকে এগিয়ে আসছে। এই জনমানহীন রাস্তায় একটা সঙ্গী পাওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। খুব আশা নিয়ে সে পিছনের দিকে তাকাতে কাউকেই দেখতে পেল না। অথচ ছায়াটা তার দিকে তখনও এগিয়ে আসছে। কিছু ভেবে ওঠার আগেই ছায়ার পা ঠিক তার পায়ের তলায় এসে থেমে গেল। হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে জয়ন্ত দৌড় লাগাল। দৌড়ানোর সময় সে লক্ষ্য করল ছায়াটাও সমান তালে একেবারে পায়ে পা মিলিয়ে তার সাথে দৌড়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুটা দৌড়ানোর পর জয়ন্ত থেমে গেল। এতটাই হাঁপিয়ে গেছে যে ছাতা কাঁধের উপর রেখে দু-হাত দিয়ে হাঁটু ধরে ঝুঁকে দাঁড়ালো। সামনের ছায়াটা ভালো করে দেখতে লাগল।
এখন ছাতার ছায়া বেশ রাস্তায় পড়েছে। ছাতাটা হাত দিয়ে ঘোরানোর সাথে সাথে ছাতার ছায়াটাও ঘুরতে লাগল। নিজের ডান হাত ঘুরিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে তার ছায়া দেখল। সব কিছু একেবারে মিলে যাচ্ছে দেখে নিজের ছায়া ভেবে সে মনে মনে একটু আশ্বস্ত হল। ইতি মধ্যে তেষ্টায় তার ছাতি ফেটে যাচ্ছে। ব্যাগে রাখা খালি বোতল থেকে যদি এক-দু ফোঁটাও জল পায় সেই আশায় ব্যাগ খুলল।
- একি! জলের বোতল গেল কোথায়? তবে কি দৌড়ানোর সময় ব্যাগ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেছে?
হয়তো তাই।
চূড়ান্ত নিরাশায় ডুবে থাকা চোখে ফেলে আশা রাস্তার দিয়ে একবার তাকালো। অনেক দূরে একটা গাড়ির ভাসা ভাসা প্রতিচ্ছবি সে দেখতে পেল। মনে মনে ভাবল গাড়িটা এলে কোনো রকম ভাবে একটু অনুরোধ করে তাতে উঠে পড়বে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকেও সে বুঝল না গাড়িটা তার দিয়ে আসছে না একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। অগত্যা সে আবার এগিয়ে চলল রাস্তা ধরে। তবে এবার সে কয়েক পা এগোনোর সাথে সাথে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে গাড়িটাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর অতিরিক্ত আলোর জন্য পিছন ফিরে সে গাড়িটাকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু সামনে ফিরতেই সে দেখল তার থেকে বিশ-ত্রিশ পা দূরে একটা ছোট্টো টিনের ছাওনি। তাড়াতাড়ি সেই দিকে এগিয়ে গেল।
- আরে, এটা যে একটা চা-বিস্কুটের দোকান। এই রাস্তায় এতদিন যাতায়াত করছি কিন্তু এমন
দোকান কখনো চোখে পড়েনি। চারিদিক এতো ফাঁকা কেন? এই রাস্তার ধারে এতো ফাঁকা জায়গা
থাকা কিভাবে সম্ভব?
প্রশ্ন গুলো মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে সে একেবারে দোকানের সামনে এসে হাজির হল। দোকানের সামনে বাঁ- দিকের কোণায় কয়লার উনুনে বসানো কেটলি থেকে সোঁ সোঁ শব্দ করে বাষ্প বেরোচ্ছে। কাঁচের বড় বড় বোতলে ভরা বিস্কুট-চানাচুর উঁচু কাঠের তাকে এমন ভাবে রাখা যে দোকানের ভিতরের অংশ কিছুই দেখা যায় না। কাউকে দেখতে না পেয়ে জয়ন্ত ডাক দিলো,-”কেউ আছেন?”
ডাকার সাথে সাথে একটা মেয়ে উঠে দাঁড়াল, যেন সে দোকানের ভিতর লুকিয়ে থেকে জয়ন্তের ডাকের অপেক্ষা করছিল। জয়ন্তের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল,-”কি লাগবে দাদা?”
এই কাঠ-ফাটা রোদের মাঝে হেঁটে-দৌড়ে জয়ন্তের গলা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখে সব আবছা ধোঁয়াশা দেখছে। কথা বলতে গিয়ে সে দেখল যে তার জিভ এতটাই শুকনো হয়ে গেছে যে কথা বেরোচ্ছেনা তার গলা থেকে। অনেক কষ্টে সে বলল,-”জল। একটু জল।”
মেয়েটা এক বোতল জল এগিয়ে দিল। জয়ন্ত এক নিঃশ্বাসে বোতলের অর্ধেক জল শেষ করে বাকি জল চোখে- মুখে ও মাথায় ঢেলে দিল। একটু সুস্থ বোধ করতে সে মেয়েটার দিকে তাকালো। তাকে দেখে প্রায় কুড়ি-একুশ বছর বয়স বলেই মনে হয়। পরণে একটা আধ ময়লা চুড়িদার। গামছাটাকেই একটু ভাঁজ করে ওড়নার মতো কাঁধের উপর নিয়েছে। দুস্থতার ছাপ জামা-কাপড়ে লেগে থাকলেও চোখ তার উজ্জ্বল ও সাবলীল। একটা মায়াবী আকর্ষণ আছে সেই চোখের মধ্যে। বোতলটা ফেরত দিতে গিয়ে সেদিকে চোখ পড়তেই জয়ন্ত অবাক হয়ে গেল। এটা যে হুবহু তারই বোতলের মতো দেখতে। একই রং, একই কোম্পানির লোগো এমনকি ছিপির উপর চেরা দাগটা পর্যন্ত মিলে যাচ্ছে। এতোটা মিলে যাওয়া সত্যিই কি সম্ভব?
মনের প্রশ্ন গুলো মুখ ফুটে বেরোনোর আগেই একদল লোকের হৈচৈ দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। পিছন ফিরে তাকাতেই জয়ন্ত দেখল একটা জিপ-গাড়িতে করে জনা পাঁচেক লোক হৈ হৈ করে নামছে। গাড়িটা দেখে তার মনে হল যেন এই গাড়িটারই প্রতিচ্ছবি দেখেছিল কিছুক্ষণ আগে।
একে একে গাড়ি থেকে নেমে তারা দোকানের দিকে এগিয়ে আসছে। তাদের মধ্যে একজনকে অবিকল তার বাবার মতো দেখতে। খুব অবাক হয়ে সেই লোকটার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে রইল। একটু কাছে আসতেই নিজের অজান্তে সে,- ”বাবা” বলে ডেকে উঠল। লোকটা কিছু একটা বলছে তা সে শুনতে পাচ্ছে কিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না। একেবারে কাছে আসতে ”যা গাড়িতে গিয়ে বস্”- শুধু এই কথা টুকুই সে শুনতে পেল। এ যে মেঘ না চাইতেই জল। সে তাদের কাছে অনুরোধ করে কালিকাপুরে ছেড়ে দিতে বলবে ভেবেছিল কিন্তু তাকে আর তা বলতে হল না। জয়ন্ত মামার বাড়ি পৌঁছানোর এমন সহজ উপায় হাতের সামনে পেয়ে বোতলের কথা ভুলে গেল। তাড়াতাড়ি বোতলটা দোকানের তাকে রেখে উগ্র মদের গন্ধ উপেক্ষা করে গাড়িতে এসে বসলো। ইতিমধ্যেই লোকগুলোর সাথে দোকানের মেয়েটার কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে। জয়ন্ত কিছু বোঝার আগেই দেখল একজন দৌড়ে এসে গাড়ি স্টার্ট দিল আর বাকি চার জন মেয়েটার হাত মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে জোর করে গাড়িতে এনে তুলল। জয়ন্ত তাদেরকে কিছু বলার ও মেয়েটাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলো কোন এক অমোঘ শক্তি তাকে ক্ষমতাহীন করেছে। সে চিৎকার করে যা বলছে তা যেন শুধু সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে। গাড়ির বাকি লোকগুলো কেবল তার কথা নয় তার অস্তিত্বকেই অগ্রাহ্য করছে।
গাড়ির মধ্যে মেয়েটা হাত-পা ছুঁড়ে নিজেকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা লোকটার মাথায় কয়েক বার জোরে ধাক্কা দিতেও সে সক্ষম হল। ফলত, গাড়িটা একবার রাস্তার ধারে নেমে গিয়ে আবার দোল খেয়ে রাস্তায় ফিরে এলো। গাড়ি দোল খাওয়ায় বাকিদের মাথা হাত গাড়ির সাথে ধাক্কা খেল। তাতে সবাই প্রচণ্ড রেগে গিয়ে মেয়েটাকে মারতে শুরু করল। গামছা দিয়ে তার মুখটা আরো জোরে বেঁধে দিল যাতে চিৎকার করতে না পারে। মার খেয়ে মেয়েটা একটু সময়ের জন্য একেবারে নিস্তেজ হয়ে গেল। গাড়ির গতি তখন হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়েছে। একটা বাক্স থেকে ঠান্ডা বিয়ারের পাঁচটা বোতল খুলে সবাই একটা একটা করে খেতে শুরু করল। একজন কিছুটা ঠান্ডা বিয়ার মেয়েটার নিস্তেজ মুখের উপর ঢেলে দিল।
মিনিট দশেক এভাবে কাটার পর, হঠাৎ করে মেয়েটা এক লাফ দিয়ে ড্রাইভারে উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গাড়ির স্টায়ারিং ধরে একদিকে অনেকটা ঘুরিয়ে দিল। দেখতে দেখতে দুরন্ত গাড়ি রাস্তা ছেড়ে মাটি ছুঁলো। ড্রাইভার তাড়াতাড়ি করে উল্টো দিকে আরো বেশী ঘুরিয়ে গাড়ি আবার রাস্তায় তুলল কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। গাড়ি রাস্তা পার করে অন্যদিকের ল্যাম্প পোস্টে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে খালের উপর উল্টো করে এসে পড়ল। খালে জলে গাড়ি অর্ধেকের বেশী ডুবে গেছে।
জয়ন্ত মাথার পিছনে ও কপালে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা খেয়েছে। হয়তো কেটেও গেছে। কিন্তু কিছুই বোঝার মতো পরিস্থিতে সে এখন নেই। অনেক চেষ্টা করে সে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে। মাথাটা তার যন্ত্রনায় ফেটে যাচ্ছে। গাড়ির ভিতরে থাকা বাকী ছ’টা মানুষের মধ্যে কেউই আর বেরিয়ে এলো না। একবার ভাবলো বাকী মানুষ গুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করি, কিন্তু অসহ্য মাথার যন্ত্রণা তার সারা শরীর অবশ করে খালের ধারেই তাকে অচেতন করে দিল।
জয়ন্ত যখন চোখ খুলল তখন সে মামার বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছে। তার মা তার পাশে বসে। দাদু-দিদা, মামা- মামী-ভাই সবাই তার চারিদিকে ঘিরে আছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। যন্ত্রণাটা আছে তবে তখনের তুলনায় অনেকটা কম। সবার দিকে একবার সে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। সবাই কিছু না কিছু বলে শেষে তাকে ’ঘুমা’ বা ’রেস্ট’ কর বলে একে একে চলে গেল। তিন-চার দিন পর একটু সুস্থ হতে জয়ন্তের কাছে সবাই জানতে চাইল সেদিন আসলে কি হয়েছিল। জয়ন্ত সেই দুর্ঘটনার কথা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল,-”চূড়ান্ত রোদে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম তারপর আর কিছু মনে নেই।”
জয়ন্ত দেখল সবাই তার কথা বিশ্বাস করে নিয়েছে। কেউ সেই দুর্ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথাই বলছে না।
জয়ন্তের মামা হেসে হেসে বলল,-”একেবারে বাড়ির কাছে এসেই ভিরমি খেয়েছিস। ওই বড় রাস্তার ধারে পড়েছিলিস। নেহাত তোকে চেনে এখানে সবাই তাই তাড়াতাড়ি আমায় খবর দেয়। না হলে সারা রাত ওই রাস্তার ধারেই পড়ে থাকতিস।”
আরও কয়েকটা দিন মামার বাড়ি কাটিয়ে সেই একই পথে জয়ন্ত মায়ের সাথে বাড়ি ফিরলো। ফেরার পথে সে না কোনো টিনের চাল দেওয়া দোকান দেখতে পেল না কোনো ধু ধু প্রান্তর। রাস্তার ধারে একটুও জায়গা ফাঁকা পড়ে নেই। বাড়ি ফিরে অনেক ভেবে জয়ন্ত তার মাকে জিজ্ঞাসা করল,-”আচ্ছা মা, বাবা যে দিন মারা যান সেদিন কি বাবার সাথে আরও চার জন বন্ধুও কি মারা যায়?”
জয়ন্তের মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,-”মাল খেয়ে গাড়ি চালালে যা হয়। কেউ বাঁচেনি সেদিনের দুর্ঘটনায়।”
জয়ন্ত এবার একটু ভরসা করে জিজ্ঞাসা করল,-”সেদিন কি কোনো মেয়ে সেই দুর্ঘটনায় মারা যায়?”
প্রশ্ন শুনে জয়ন্তর মায়ের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে কপালের শিরা ফুলে উঠল। বিন্দু বিন্দু ঘাম তখন সবে ঘনীভূত হচ্ছে।