বৃষ্টির চরিত্র বোঝা বড়ই কঠিন। টানা তিন মাস ধরে অঝরে ঝরার পরেও কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মেঘ এসে পুরো আকাশটা দখল করে সবকিছু ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মহালয়ার ভোরে এমন বৃষ্টি আর ঝড় হল যে মাঠের পাশে শিমুল গাছের মোটা ডাল ভেঙে ইলেকট্রিকের তার ছিঁড়ে প্রায় দু-দিন লোডশেডিং। সারা বর্ষাকাল জুড়ে এলাকার ওলি-গলি গুলো প্রায় সবসময়ই জলের নীচে ছিল। অফিস-স্কুল-কাছারি সবকিছুই বন্ধ ছিল অনেকদিনের জন্য। এমনকি দোকান-পাঠও দিনের বেলা মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য খোলা থাকত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি কলেরা-ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়াতে প্রাণহানির সংখ্যা দুই-অঙ্কে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতির জটিলতাকে মাথায় রেখে মাস দেড়েক আগে কর্পোরেশন থেকে লোক পাঠিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করার পর জীবনযাত্রা কিছুটা স্বাভাবিক গতি পায়।
হাইওয়ের পাশে এই এলাকা, শিমুলতলা, এখনো পুরোপুরি শহর হয়ে না উঠলেও গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তরের পথে অনেকদিন আগেই পাড়ি দিয়েছে। তাই গ্রামের সরল জীবনকে ভেঙে আধুনিক শহুরে সজ্জায় সেজে উঠছে দিনে দিনে। আগেকার দিনের মাটির বাড়ি, টালি বা খড়ের ছাউনি হয়েছে কংক্রিটের দেশলাই বাক্স। বাড়ির সামনের উন্মুক্ত উঠান হয়েছে খাঁচায় বন্দি ব্যালকনি। উঠেছে অনেক বহুতল বাড়ি, ফাঁকা মাঠ গুলো দখল করেছে স্কুল কলেজ অফিস কাছারি হাসপাতাল আর ক্লাব ঘর। নিজেদের জমি-জমা হারিয়ে অনেক পরিবার যেমন উঠে গেছে অন্যত্র তেমনই অনেক নতুন মানুষের আগমণ হয়েছে। সাধারণ মানুষের গায়ে ও মনে দেখা দিয়েছে শহুরে চাকচিক্য। ক্লাবগুলোর দৌলতে প্রায় প্রতি মাসে কিছু না কিছু অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। একটা সময় যে শিমুলতলা সন্ধ্যায় শাঁখের শব্দের সাথে এক সুখের ঘুমচাদরের তলায় আস্তানা নিত সে আজ বিনিদ্র রজনী যাপন করে। সন্ধ্যায় শাঁখের শব্দের বদলে এখন শোনা যায় দাম্পত্য বা পারিবারিক কলহ কখনো টেলিভিশনে কখনো বা বাস্তবে। সূর্যাস্তের পর এখন নামে এক গাঢ় অন্ধকারের চাদর যার আচ্ছাদনে শিমুলতলা নেয় এক অন্য রূপ, দিনের শিমুলতলার সাথে যার মিল শুধু মাত্র ভৌগোলিক অবস্থানেই।
এই এলাকার এক অত্যন্ত প্রবীণ মানুষ হলেন হৃষিকেশ গাঙ্গুলি। একটা সময় প্রচুর জমি-জমার মালিক ছিলেন কিন্তু বর্তমানে শুধু মাত্র নিজের বসত বাড়িটুকু ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেন নি। রেলে কর্মরত অবস্থায় তিনি এই এলাকায় আসেন এবং তারপর এখানেই থেকে যান। হৃষিকেশ বাবুর একমাত্র ছেলে সুকুমার, ক্লাবঘর জুয়া আর মদের নেশায় পৈত্রিক সম্পত্তি ও নিজের যৌবন প্রায় অর্ধেক শেষ করার পর বাবার চেষ্টায় স্থান পায় রেলের অধস্তন কর্মচারীর পদে। তারপরেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে তার জীবনে আসে এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান। সন্তান আগমনের সম্ভাবনার খবর পাওয়ার পরপরই সুকুমারের জীবন অন্ধকার জগৎ ছেড়ে আলোর পথে ফিরে আসে। সুকুমারের এই পরিবর্তন দেখে হৃষিকেশ বাবু নাতনীর নাম রাখেন জ্যোতি। মা-বাবা ও দাদুর আদরে বড় হয়ে ওঠা জ্যোতির জীবনে কোনো কিছুরই কালো ছায়া তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই পড়াশুনায় খুব ভালো হওয়ার সাথে সাথে নাচে ও গানে সমপারদর্শীতা তাকে সবার মনের মাঝে একটা জায়গা বানিয়ে নিতে সাহায্য করে। নিত্য-নতুন স্বপ্ন বোনা ও তা বাস্তবায়িত করাই তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বয়সের সাথে সাথে তার স্বপ্নগুলোও আরও রঙিন ও কল্পনা প্রবন হয়ে ওঠে। পড়ন্ত বিকালে নিজেদের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে গগনচুম্বী ইমারত গুলোর উপর দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘপুঞ্জের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নের জগতে। এক হাতে দাঁড় টেনে ভাসিয়ে দেয় তার স্বপ্নের ভেলা কোনো এক অদেখা-অজানার পথে। হয়তো কোথাও থামবে ক্ষণিকের জন্য কখনো বা কিছু দীর্ঘক্ষণ, তবু এগিয়ে যেতেই হবে নাহলে তার স্বপ্নই থমকে যাবে।
মাধ্যামিক পাস করার পর জ্যোতিকে ছোটবেলার স্কুল ছেড়ে একটু দূরের স্কুলে ভর্তি হতে হয়। এই স্কুলটা এলাকার মধ্যে হলেও হেঁটে যেতে প্রায় বিশ-পঁচিশ মিনিট লাগে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে টিউশানির সংখ্যাও বেড়ে যায় সমপরিমানে। নতুন স্কুল, টিউশানি, বেড়ে ওঠা বন্ধুদের দল, প্রথম হাতে পাওয়া স্মার্ট ফোন, বাবা ও দাদুর কাছে পাওয়া হাত খরচের টাকা, স্কুল বাঙ্ক মেরে পার্কে ও সিনেমা হলে যাওয়া, প্রথম কোনো ছেলের থেকে পাওয়া ভালোবাসার অঙ্গীকার – সব কিছু মিলিয়ে জ্যোতির জীবন হয়ে ওঠে বর্ণময় রামধনু। কিন্তু না চাইতেও কিছু টুকরো কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয় তার প্রাণোচ্ছল জীবনের আকাশে। টিউশানি ও স্কুল যাওয়ার পথে রাস্তার ধারে রেলিং-এর উপর বসে থাকা কিছু বখাটে ছেলেদের দৃষ্টি ও ভাষা তার শরীর ও মনের উপর আনে বিষণ্ণতার আবেশ। ভাগাড়ে মরা জন্তু পড়লে মেঘের বুক চিরে আকাশের অনেক উঁচু থেকে শকুন যেমন নজর রাখে তেমনই শানিত ছুরির ধার এদের দৃষ্টিতে। তার উদ্দ্যেশে ভেসে আসা কিছু কথা যেন জ্বলন্ত লাভা কানে ঢেলে দেওয়ার মতই বেদনাদায়ক। তবু তাকে এই পথেই আসতে হবে প্রতিদিন। অন্য পথ আছে কিন্তু সে পথও পরিষ্কার নয়। জঞ্জালের আড়ত কোনো রাস্তাকেই অব্যাহতি দেয়নি।
প্রথম কিছুদিন বাবা তাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু ফিরতে হয়েছিল একা একা। তারপর স্কুলের কিছু মেয়ে মিলে একসাথে আসা-যাওয়া শুরু করে। দলবদ্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও প্রত্যেকের মনে একটা ভয়ের বাসা অনেকদিন আগে থেকেই বেঁধেছিল। স্কুল যাওয়ার সময় ছেলেগুলোর খুব একটা দেখা পাওয়া যেত না, দৈবাৎ দু-একজন কে ছন্নছাড়া হয়ে এ-গলি ও-গলিতে দেখা মিলিত। কিন্তু বিকালে স্কুল থেকে ফেরার সময় বা একটু সন্ধ্যায় টিউশানি থেকে ফেরার পথে তাদের অবশ্যই দেখা পাওয়া যেত। কিন্তু কখন কোথায় তাদের উদয় হবে তা ছিল সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। কখনো হঠাৎ করে একটা গলি পেরিয়ে অন্য গলিতে ঢোকার মুখে একেবারে সামনাসামনি হাজির হতো কখনো বা টিমটিমে আলো জ্বালানো চায়ের দোকান থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতো নানাবিধ মন্তব্যের সাথে। কখনো কখনো দু-তিনটে গলি তাদের পিছু নিয়ে হঠাৎ করেই উধাও হয়ে যেত। বাড়িতে কয়েকবার এই ঘটনা জানানোর পর খুব যে কিছু লাভ হয়েছে তা নয়। যখনি মেয়েদের সাথে তাদের বাবা-মা বা বয়স্ক মানুষ থাকতো তাদের টিকিটিও দেখা যেত না। এমনভাবেই কেটে গেল জ্যোতির স্কুল জীবন।
কলেজে ওঠার পর পরই জ্যোতি লক্ষ্য করল, ফেরার পথে প্রায় প্রতিদিন কয়েকটা ছেলে কিছুটা দূর থেকে তাকে অনুসরণ করতে করতে তাদের বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে আসছে। কয়েকদিন এমন হওয়ার পর একদিন বাড়ি ফেরার পথে জ্যোতি হঠাৎ করেই পিছন ফিরে তাকায়। সাথে সাথে সেই পাঁচ-ছয়টা ছেলে যে যার মতো এদিক ওদিকে মুখ লুকিয়ে নিজেদেরকে আড়াল করল। কাকতালীয় ভাবে এরপর থেকে কয়েক সপ্তাহ তাদের উপদ্রব একেবারেই লোপাট হয়ে গেল। এমনকি দূর থেকে কোনো বাজে মন্তব্য পর্যন্ত কানে এলো না জ্যোতির। এতো সহজে এতদিনের একটা সমস্যা কেটে যাবে এটা একেবারেই তার কাছে অভাবনীয়। জ্যোতি সেদিনের হঠাৎ করে ফিরে তাকানোর ফলাফলটা বেশ মন খুলে উপভোগ করছে, যেন অনেক দিন পর একটা মুক্তির স্বাদ তার শরীর মন জুড়ে বয়ে চলেছে। বেশ কিছুদিন এমনটা চলার পর একদিন কলেজ যাওয়ার পথে একটা কাগজের গোলা তার গায়ে লেগে গড়িয়ে গড়িয়ে রাস্তার ধরে চলে গেল। থমকে গিয়ে চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে পেল সেই ছেলেদের দলের মধ্যে একজন ইশারা করে কাগজটা তুলে নেওয়ার কথা বলছে। মুখের উপর প্রচন্ড রাগ ভাব এনে সেখান থেকে সে চলে আসে। সেদিন ফেরার পথে ওই ছেলেটাই কাগজটা হাতে নিয়ে রাস্তার এক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকটা দূর থেকে দেখতে পেয়ে জ্যোতি তার দিকে না তাকিয়ে হনহন করে রাস্তাটা পের হয়ে যায়। এরপর প্রতিদিন সেই কাগজটা হাতে ধরে ছেলেটা রাস্তার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। সে কাছাকাছি এলে কাগজটা বাড়িয়ে দেয় তার দিকে আর মাঝে মাঝে বলে ওঠে -‘কাগজটা নিয়ে পড়ে দেখো।’ একটা দৃঢ় কটাক্ষ দৃষ্টি হেনে নিজের পথে এগিয়ে যেত জ্যোতি। স্বভাববশত রাগ আর অবজ্ঞায় ভর দিয়ে কিছুদিন এমনভাবেই কাটলো। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ছেলেটা একটু একটু করে সাহস বাড়িয়ে জ্যোতির পথ আগলে ধরছে, আর অন্য দিকে একটা অজানা আশঙ্কা জ্যোতির মনে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে। সে জানতো, একবার যদি তার মনের ভয় বাইরে প্রকাশ পায় তাহলে তাকে ভয়ের অন্ধকারেই ডুবে যেতে হবে। তাই মুখে রাগ আর চোখে অবজ্ঞাটাই ধরে রাখার নিরন্তর প্রয়াস চালাতে থাকে।
এই প্রথম কলেজের বন্ধুদের সাথে দুর্গা পুজায় নিজের এলাকার বাইরে পা রাখল জ্যোতি। কলেজের বন্ধুদের সাথে পুজোর চারটে দিন খুব আনন্দ করে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এলো। বিজয়া দশমীতেও সে চেয়েছিল বাবুঘাটে গিয়ে বিসর্জন দেখবে কিন্তু বাড়ি থেকে তা মেনে নিল না। দশমীর সন্ধ্যায় পরিচিতদের বাড়ি বাড়ি মিষ্টি নিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করে আসার রীতি অনেক কাল থেকেই চলে আসছে। জ্যোতিকেও তা মেনে চলতে হবে। তাই সন্ধ্যার পর মিষ্টি নিয়ে অনেকগুলো বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। প্রত্যেকের বাড়িতে কিছু না কিছু খাওয়া, বসে গল্প করা- এই সব কিছু করতে করতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত ঘনিয়ে এসেছে তার খেয়াল ছিল না। একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় পা রাখতেই জ্যোতি দেখল রাস্তা একেবারে জন-মানব শূন্য। দূরে নদীর ঘাট থেকে ভেসে আসা মানুষের কোলাহল, ফুল-ভলিউমে মাইকের গান আর উজ্জ্বল আলোর ছটা ছাড়া আর কিছু তার অনুভুতির গোচরে এলো না। এখনও তাকে আরও দুটো বাড়িতে যেতে হবে।
নির্জন রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে একটা গলির মুখে বাঁক নিতেই হঠাৎ করে একেবারে সামনে এসে হাজির হল চিরকুট নিয়ে পথ আগলে ধরা সেই ছেলেটা, যেন সত্যি সত্যিই মাটি ফুঁড়ে তার উদয় হল। নেশাগ্রস্থ হয়ে মাথা মুখ গুঁজে অসংলগ্ন কিছু কথা বিড়বিড় করে বলতে থাকল সে যার কিছুই জ্যোতি বুঝতে পারল না। বিরক্ত হয়ে ‘এই পথ ছাড়’- বলে ধমকে উঠল সে। ছেলেটা এবার চোখ তুলে তাকাল। কোটোর থেকে রক্ত জবার মতো লাল হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো দেখে জ্যোতির বুক কেঁপে উঠল। সে চোখে যেন এক ধ্বংসের আগুণ ধিক ধিক করে জ্বলছে- যে কোনো মুহূর্তে তা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির রূপ নিতে পারে। অপ্রত্যাশিত ভাবে একটা শক্ত পাঞ্জা জ্যোতির বাঁ হাতের কব্জির উপর এসে পড়ল। নেশাগ্রস্থ গলাটা উগ্র হয়ে বলে উঠল,-‘তোর এতো দেমাক কিসের রে?’
ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে জ্যোতি। যতটা সম্ভব নিজের গলায় জোর এনে বলল,-‘হাত ছার না হলে আমি চিৎকার করব।’ পৈশাচিক হাসির সাথে ছেলেটা বলল,-‘আজ তোর সব দেমাক ধুয়ে দেব।’ জ্যোতির কব্জির উপর থেকে ছেলেটার পাঞ্জা আলগা হতেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগেই তার চোখ দুটো অসহ্য যন্ত্রণায় বুজে গেল, মুখের চামড়া কে যেন জোর করে তার মুখ থেকে খুবলে খুবলে তুলে নিচ্ছে। চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সে। পিচ ঢালা রাস্তার উপর ফুটতে থাকে তার মুখ থেকে গলে পড়া রক্ত-মাংসের তাল। তার আর্ত-চিৎকারে আসে পাশে কিছু বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলো কিছু মানুষ। একটা হৈচৈ সোরগোল তারদিকে ছুটে আসতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে চোখের উপর নেমে আসে এক অন্ধকারের আবরণ। মাথার মধ্যে সব কিছু তালগোল পাকিয়ে চিন্তা শক্তির অবসান হয়। তার দিকে এগিয়ে আসা কোলাহলের শব্দ গুলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। নিজের চিৎকারের শব্দ ও তার কানে পৌঁছাচ্ছে না এখন। গলার আওয়াজ ও নিষ্প্রভ হয়ে এল। সময়ের কাঁটা এক-পাক ঘোরার আগেই জ্ঞান হারায় জ্যোতি। গলির অন্ধকারে ছেলেটার ডান হাতে লুকিয়ে রাখা অ্যাসিড ভরা গ্লাস তার চোখে পড়েনি।
আজ বিজয়া দশমী। সন্ধ্যা হতেই চারিদিকে মাইকে ঢাকের শব্দে এলাকার কাক-পক্ষীও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখন আর আসল ঢাক বাজানো হয়ে না, রেকর্ডিং করা ঢাকের শব্দ বাজে। আতস বাজির আলো মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশের অনেকটা অন্ধকার মুছে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা বাড়িতেই অতিথির আনাগোনা এতটাই বেশি যে চিৎকার চেঁচামেচিতে নিজের কথা নিজেই শুনতে পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু রাত হতে অতিথিরা সব বিদায় নিলো জ্যোতির বাড়ি থেকে। টেবিলের উপর রেখে যাওয়া খাবারের গন্ধ নাকে আসছে অনেক ক্ষণ। খুব একটা খিদে নেই, তবু রাতে কিছু না খেলে ঘুম আসবে না। বিছানার পাশে রাখা ব্লাইন্ড স্টিকটা হাতে নিয়ে উঠে বসল জ্যোতি। মেঝেতে হালকা শব্দ করতে করতে বাইরে বেরিয়ে এলো।
জ্যোতিকে বাইরে আসতে দেখেই তার মা বললেন,-“খাবার গুলো এখনও ফেলে রেখেছিস মা। ঠান্ডা হয়ে যাবে তো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। আর কত রাত করবি বল।”
আরএকটু খিদেটা পেলেই খেয়ে নেবো। বেশি দেরী করব না। " - বলে ধীরে ধীরে বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে থামল জ্যোতি। অতিথিরা সবে মাত্র বিদায় নিয়েছে তাই দরজাটা এখন খোলা। স্টিক দিয়ে সামনেটা একটু দেখে নিয়ে দু-পা এগিয়ে দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালো সে। একটা দমকা হাওয়া তার খোলা চুল এলোমেলো করে দিল। স্টিকটা গুটিয়ে নিয়ে বাঁ হাতে শক্ত করে ধরল। ডান দিকের গলি পথ দিয়ে দমকা হওয়ার পিছন পিছন একটা পাঁশুটে গন্ধ তার ঝলসে যাওয়া ভ্রূয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলল। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় আরো প্রখর হয়ে ওঠে। তৃতীয় নেত্র তার দৃষ্টির আধার হল। হয়তো গলির ওপারে শিকারের আশায় চুপটি করে বসে আছে কোনো এক ধূর্ত শয়তান। তার রক্ত হিম করা নিঃশ্বাসের প্রতিটা উপলব্ধি জ্যোতির শিরা- উপশিরায় বিদ্যুতের চাবুক মেরে মুহুর্মুহ কাঁপিয়ে তুলছে। শয়তান আজও সুযোগ খোঁজে, অন্যের উপর নিজের পাঞ্জা বসানোর নেশা তার আজীবনের। কে জানে আজ হয়তো কারোর শরীরকে নিজের বাসনার উপাদেয় বানাবে।