হিথরো এয়ারপোর্টে ফ্লাইট্টা ল্যান্ড করেছে পনেরো মিনিট দেরিতে। আর মাত্র কুড়ি মিনিট পরেই কোপেনহাগেন যাবার কানেক্টিং ফ্লাইট্। লম্বা লম্বা পা ফেলে ট্র্যান্সফার জোনের দিকে এগোয় অভি।
সিকিউরিটিতে লম্বা লাইন। পাইথনের মতো এঁকেবেঁকে চলেছে। চেকিংয়ে আজও বোধহয় খুব কড়াকড়ি। গত সপ্তাহে ওয়েস্টমিন্সটারে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘা এখনো শুকোয়নি লন্ডনের শরীর থেকে।
শিকাগো থেকে ন-ঘণ্টা উড়ে এসেছে অভি। শরীরটা অসম্ভব টায়ার্ড। এরপর যদি ফ্লাইট্ মিস্ করে, তাহলে পরের ফ্লাইটের জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে। জেট্-ল্যাগে একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে সে। কাল থেকেই শুরু হচ্ছে তার কোয়ান্টাম্ ফিজিক্সের কনফারেন্স।
সিকিউরিটির পর অভি তার কেবিন লাগেজদুটো দুহাতে সামলাতে সামলাতেই প্রায় দৌড়োতে শুরু করল বোর্ডিং গেটের দিকে। কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই সে শুনতে পেলো মেয়েলি কণ্ঠে তার নামে যান্ত্রিক আহ্বান… বোর্ডিং কল। মরিয়া হয়ে পা চালিয়ে কোনও রকমে গেটে পৌঁছল অভি।
যাক্, ফ্লাইট্টা মিস করেনি সে।
প্লেনটা মাটি ছেড়েছে প্রায় মিনিট পনের হল। মনটা এখন বেশ রিলাক্সড্ অভির। উইন্ডো-শেড্টা অর্ধেক নামিয়ে একটা লার্জ হুইস্কির অর্ডার দেয় সে।
হুইস্কির গ্লাসটা হাতে নিয়ে, কানে হেডফোন গুঁজে, চোখ বন্ধ করে সীটে গা এলিয়ে দেয় অভি। নর্থওয়েস্টানর্ে তাদের রিসার্চ গ্রুপের বড়ো প্রজেক্টটা শেষমেশ সাকসেসফুল হয়েছে। অভি তারই রেজাল্ট প্রেজেন্ট করবে কালকের কনফারেন্সে। রীতিমতো ‘গ্রাউন্ড-ব্রেকিং’ কাজ বলেই তাদের ধারনা। সাড়া পড়ে যাবে কনফারেন্সে। ভেবে বেশ উত্তেজনা অনুভব করে অভি।
দস্তুরমতো প্রতিষ্ঠিত সায়েন্টিস্ট এখন সে… গ্রিন-কার্ড এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
চোখ বুজে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে অভির হঠাৎ খেয়াল হয়, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বস্তি উঁকি দিচ্ছে মাঝে মাঝে… ফেলুদার ভাষায় যাকে বলে ‘খট্কা’।
কপালে সামান্য ভাঁজ পড়ে অভির। সে কি কোনো কিছু ভুলে যাচ্ছে? কোনো স্কেজু্যল্ড মিটিং?… কোনো আর্জেন্ট ফোনকল?… কোনো ডকু্যমেন্ট?
হেডফোনটা কান থেকে খুলে সে এবার সোজা হয়ে বসে। মনে করার চেষ্টা করে গত কয়েক ঘণ্টার ঘটনাগুলো।
হঠাৎই বিদ্যুৎচমকের মতো একটা কথা মাথায় আসে তার।
সে যখন বোর্ডিং গেটের দিকে দৌড়োচ্ছিলো, কানে এসেছিলো তার নামে বোর্ডিং কল। অন্তত বার-দুয়েক। যতদূর মনে পড়ছে, প্রথমবার তার নামটা ডাকা হয়েছিলো যথারীতি ধারালো ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে। কিন্তু তার ঠিক পরে-পরেই যেন একটা মেয়েলি কণ্ঠের নরম ডাক…
তাইতো!
দ্বিতীয়বার তার রীতিমতো খটোমটো নামটা ডাকা হয়েছিলো নিখুঁত বাংলা উচ্চারণে!
অভিনন্দন শিকদার…
এটা কি করে হয়? অবশ্য ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে কোনো বাঙ্গালী মহিলা ক্রু থাকতেই পারে। কিন্তু একজন বাঙ্গালীকে বিদেশের মাটিতে সম্পূর্ণ বাংলা উচ্চারণে নাম বলতে শোনা যায় কি?
“উঁহু, দিস্ ইজ কোয়াইট আনইউজুয়্যল”, ভেবে অবাক হয় অভি। আচমকা একরাশ সমুদ্রের গন্ধ মেশা হাওয়া এসে যেন তার ‘অরগ্যানাইজড্’ মনটাকে এলোমেলো করে দেয়।
গ্রিন-কার্ডের চিন্তা ছেড়ে সে একেবারে পাক্কা গোয়েন্দার মতো ভাবতে শুরু করে, কে এই রহস্যময়ী? কলকাতার কলেজ-জীবনের কোনো বান্ধবী? কোনো বন্ধুপত্নী? আত্মীয়া?
নাহ্, সেরকম তো কাউকে মনে পড়ছে না!
সরু সরু চোখে একে একে সব কেবিন-ক্রু দের লক্ষ্য করে অভি। যদি কোনো চেনা মুখ চোখে পড়ে। না তো!
তাহলে?
হঠাৎ করে চারপাশের সবকিছুকে খুব জীবন্ত মনে হয় অভির। উইন্ডো-শেড্টা তুলে দিয়ে সে জানালার বাইরে চোখ মেলে। সমগ্র চরাচর জুড়ে, অপার্থিব স্নিগ্ধতায় ভরা সিঁদুর-রঙা আলো … তার রোজকার দুনিয়ার অনেক অনেক উপরে, মেঘেদের রাজত্বে সূর্য ডুবছে।
চোখ পড়ে পাশের সীটে বসে থাকা মেয়েটির দিকে। মেয়েটি সম্ভবত স্প্যানিশ। ছোট্ট একটা স্কেচ্-প্যাড হাঁটুর উপর রেখে ছবি আঁকছে একমনে।
অভির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেয়েটির চোখে একটা দুষ্টুমির ঝিলিক খেলে যায়।
অভি একটু অবাক হয়। তারপরই অভির চোখ পড়ে মেয়েটির খাতায়। তার খাতায় অবিশ্বাস্য ডিটেলিংয়ে ফুটে উঠেছে রোডিনের বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর্য ‘লে পঁস্যর’, যার ইংরেজি নাম ‘দ্য থিঙ্কার’… তার একটা মজার ক্যারিকেচার।
তার ছবিতেও একজন সুঠাম স্বাস্থ্যবান লোক চিবুকে হাত ঠেকিয়ে বসে। খুব গভীরভাবে কিছু ভেবে চলেছে। ঠিক যেমনটি দেখা যায় রোডিনের ভাস্কর্যে। তবে এই ছবির লোকটির মুখ এক্কেবারে অভির মতো… লম্বাটে, চোখে রিম্লেস চশমা। চুল রীতিমতো পরিপাটি। এমনকি অভির কপালের কুঞ্চনটাও বাদ যায়নি।
দারুণ মজা পায় অভি। সেও ছোটোবেলায় খুব ভালো কার্টুন আঁকতো। বহুদিন আর কিছু আঁকা হয় না।
সপ্রতিভ গলায় সে পার্শ্ববর্তিনীকে বলে,
- “অ্যাম্ আই য়্যোর মডেল?”
- “য়্যু আর দ্য থিঙ্কার, আই অ্যাম্ দ্য পেন্টার…”