(Minnesota, USA • May 2016)

ছোটবেলার স্কুলের বন্ধু শুভাশিস আমার মাকে স্মরণ করায়, ওকেই লেখা চিঠি -

সেই কোন ছোটবেলার কথা, মানুষটাকে ভুলে যাওয়ারই কথা! তবুও তুই মনে রেখেছিস। এটা জেনে বিস্মিতও হলাম, আবার তোর স্মৃতি-শক্তির ওপর আমার শ্রদ্ধাও বাড়ল।

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়তো আর ‘মাদারস ডে’ বলে কিছু ছিল না, পরে বড় হয়ে বিদেশে এসে এটা শিখি। এখন দেখছি ভারতেও এটা হয়! তবে তুই, আমি যখন বালিগঞ্জ গভর্নমেন্টের ক্লাস ওয়ানে পড়ি, তখনকার একদিনের কথা আমার এখনও বেশ মনে পড়ে। তখন তো মাদারস ডে থাকার কথা নয়, তবে কোন বিশেষ দিন ছিল নিশ্চয়। কারণ সেদিন আমাদের ক্লাস-টিচার ইন্দিরা-দি ব্ল্যাক বোর্ডের ওপর কেন জানি না লিখেছিলেন -

“মাকে আমার পড়ে না মনে
শুধু যখন খেলতে গিয়ে হটাত অকারণে
একটা কি সুর গুন গুনিয়ে কানে আমার বাজে
মায়ের কথা মিলায় তখন আমার খেলার মাঝে।”

লেখার পর ইন্দিরা-দি যখন ব্ল্যাকবোর্ড থেকে আমাদের দিকে মুখ ফেরালেন, আমার পরিষ্কার মনে পড়ে, দেখি উনি অঝোরে কাঁদছেন! কে যেন একজন জিগ্যেস করেছিলো যে উনার চোখে জল কেন? তখন উনি বলেছিলেন - “বড় হোলে বুঝবে, এখন নয়”।

সেই দিন আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি যে ঐ ঠাকুমা-দিদিমার বয়সী ইন্দিরা-দি কেন কেঁদে ছিলেন। যখন বুঝলাম, তখনো কিন্তু আমি ছোটোই! শুধু মনে হয়েছিলো এই যে, ইন্দিরা-দি ভুল বলেছিলেন, তা না হোলে আমার বড় হওয়া পর্যন্ত তো অন্তত মায়ের বেঁচে থাকার কথা!

খুব ছোটবেলায় মাকে মিস করতাম; জুতোর ফিতে বেঁধে দেওয়ার জন্য, জামার বোতাম সেলাই করার জন্য, স্নান করার সময় মাথায় জল ঢালার জন্য, নারকোল-নাড়ু, নিমকি বা রসবড়া খাওয়ার জন্য, শীতকালে হাতে বোনা সোয়েটার পড়ার জন্য, এইসব। তারপর মানুষটাকে আমি প্রায় ভুলেই যেতে বসেছিলাম, যদিও বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন তত দিন আমাদের তিন ভাইকে কিছুতেই মানুষটাকে পুরোপুরি ভুলে যেতে দেননি। বাৎসরিক পরিক্ষার ফল বেড়োনোর দিন, বা ভালো কিছু করার পর বাবাকে প্রনাম করতে গেলেই বাবা পা সরিয়ে নিতেন; দেওয়ালে টাঙানো মায়ের ছবিটা দেখিয়ে বলতেন “উঁহু, আগে মা-কে”! এছাড়া মায়ের আর তেমন কন অস্তিত্বই থাকলো না তখন আর আমার জীবনে। আর থাকবেই বা কি কোরে? বন্ধু-বান্ধব, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, ফুটবল, সিনেমা, পড়াশোনা - এইসবের মাঝে মায়ের আর জায়গা হোল না।

মাকে আবার মনে পড়লো সেই উনিশের শেষে - যখন দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি প্রায় আসন্ন। বাবা বোধ হয় প্রথমে ঠিকঠাক বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি যে আমার পক্ষে এই ‘বিদেশে-পাড়ি’ ব্যাপারটা আদৌ ঘটানো সম্ভব! কিন্তু যেদিন বুঝলেন যে আমাকে আর আটকানো সম্ভব নয়, সেদিন কাছে ডেকে বেশ কিছু ‘গম্ভীর’ কথা বলেছিলেন, যা শুনে আমি একেবারে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এর আগে বাবা কোনদিন আমাকে কন গম্ভীর কথা বলেননি। বাবা সেদিন কথা শেষ করেছিলেন এই বলে যে "কন ভয় নেই, তোমার মায়ের আশীর্বাদ সঙ্গে থাকবে”। দেশ ছাড়ার দিন মনে হয়েছিলো যে বাবার আশীর্বাদটা পেলাম কি পেলাম না তা ঠিক বোঝা গেলো না, কিন্তু বাবা মারফৎ মায়ের আশীর্বাদটা ঠিকই পেলাম! এরপর আবার সেই একই ঘটনা - মাকে আবার ভুলে গেলাম। তখন বিদেশে থিতু হওয়ার সংগ্রাম, পায়ের নিচে জমি খোঁজার সংগ্রাম; তার ওপর মজলাম মেমে! মায়ের কথা ভাবার সময় কোথায়?

মাকে আবার মনে পড়লো যখন শুরু হোল আমার ‘সিঙ্গিল-ফাদারহুড’ – আমার তিন কন্যাকে নিয়ে, যখন ওদের বয়েস মাত্র ১, ৩ আর ৪! কারণ সেই একই - ওদের জুতোর ফিতে বাঁধা, স্নানের সময় ওদের মাথায় জল ঢালা, ওদের জামার বোতাম সেলাই করা, এমনকি ক্রমে ওদের সাথেই নারকোল-নাড়ু আর রসবড়া বানানো! সোয়েটারটা এখনও ওদের জন্য বা ওদের সাথে বুনে উঠতে পারিনি, পারলে গর্বিতই হতাম! তবে হ্যাঁ, মেয়েদের মাফলার বোনা শিখিয়েছি – এই আমার ‘মায়ের ছেলে’ আমিই! আমার মধ্যম কন্যা মায়ার বানানো মাফলার সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে। এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে আমার বছর দুই ডাক্তারি পড়ার অভিজ্ঞতা, যখন শিখেছিলাম সার্জারিতে মানুষের চামড়া সেলাই!

তবে এইসবের কোনটাই আমার কাছে তেমন ‘বিশেষ’ কিছু নয়। ‘বিশেষ’ যা, তা হোল আমার মাকে আমার চিনতে পারা। যা আমি পেরেছি বিগত ১৫ বছরে, আমার তিন কন্যাকে ‘সিঙ্গিল-ফাদার’ হিসাবে বড় করতে গিয়ে। ফেলে আসা স্মৃতি বা টুকরো ঘটনা মনে পড়ায় প্রায়ই মনে হয়েছে যে কি অসাধারণ ছিলেন এই মহিলা! সহায়-সম্বলহীন (দেশ বিভাগের পর মায়ের বাপের বাড়ি হয়েছিলো বিহারের গয়ায়, যা তখনকার দিনে কোলকাতার তুলনায় ছিল ‘বিদেশ’), আত্মীয়-পরিজনহীন (মায়ের একমাত্র ভরসা ছিল আমার বাবা, যিনি কর্মসূত্রে প্রায়ই থাকতেন অন্যত্র, আর আমরা তিন ভাই ছিলাম খুবই ছোট), প্রায়ই কপর্দক-শূন্য অবস্থায় এক ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের তিন ভাইয়ের মুখ চেয়ে মায়ের বেঁচে থাকার সংগ্রাম বিগত ১৫ বছরে অনেক রসদ জুগিয়েছে আমাকে – অনেকটা প্রায় একই রকম অবস্থায় আমার তিন মেয়েকে বড় করার সংগ্রামে। প্রায়ই আমার মনে হয়েছে (বিশেষত বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখের দিনগুলোয়, যখন কোনটা আগে সামলাবো সে ব্যাপারে হালে পানি পেতাম না) যে আমার মা পেরেছিলেন, আমাকেও পারতে হবে, পারতেই হবে!

আমার মেয়েরা বড় হয়ে গেলো, আমার এই সংগ্রাম প্রায় শেষ। মায়ের ছবিতে ফুলের মালা দেওয়া ছাড়া মাকে আর কিছু দেওয়ার সুযোগ হয়নি কন দিন। তবে প্রতিকূল পরিবেশে আমার সিঙ্গিল-ফাদারহুডের সংগ্রাম হয়ে থাকলো আমার মায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।